মওলানা ভাসানী ও নতুন বাংলাদেশ

ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক বিদ্রোহের উত্তাল সময়ে কৃষক আন্দোলনের গড় খ্যাত সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া গ্রামে ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন হন তিনি। ছোটবেলা থেকেই সমাজের উঁচু নিচু ভেদাভেদের বিরুদ্ধে গরীব মেহনতি মানুষের পক্ষে তিনি সরব ছিলেন। নিজ পরিবারের খানদানিপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সুফি সাধক শাহ নাসিরুদ্দিন বোগদাদীর হাত ধরে ১৮৯৭ সালে পিতৃভূমি ছেড়ে আসাম গমন করেছিলেন।

মওলানা ভাসানী তখন যুবক। সদ্য দেওবন্দ থেকে বেরিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ১৯১৫ সালে মওলানা মোহাম্মদ আলীর সংস্পর্শে এসেছেনে। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরে জাতীয় রাজনীতিতে পা রেখেছেন। ইতিহাসখ্যাত রেশমী রুমাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। ১৯১৯ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেসে যোগদানের মধ্য দিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলি, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা হাসরত মোহানী, আল্লামা আজাদ সোবহানি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী শুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, বিপিন পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, বলগঙ্গাধর তিলক, মহামতি গোখলে, ক্ষুদিরাম বসু, সূর্যসেন প্রমুখের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সান্নিধ্যে এসে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতির আকাশে ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছেন। অতঃপর চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সেই রাজনীতিতে ছন্দপতন ঘটে।

এরপর আসামকেই মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চারণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন। সেখানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাসিত আসামের অভিবাসী বাঙালিদের পাশে দাঁড়ালেন। লাইন প্রথা ও বাঙালখেদা বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন। শুরু করলেন বাংলা-আসামে একের পর এক সাড়া জাগানো বড় বড় কৃষক সম্মেলনের। মূলত আসামের অভিবাসী বাঙালিরা পূর্ব বাংলার জমিদার মহাজন জোতদারদের অত্যাচার-নিপীড়নে নিজ বাপ-দাদার ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে আসামের জঙ্গল চাষাবাদ করে সেখানে বসতি গেড়েছিলেন। আসামের এই মানুষগুলো ছিল নিম্নবর্গের চেয়েও নিম্নবর্গ। যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিভাষা ছিল না। এই রাজনৈতিক পরিভাষাহীন জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের মধ্য দিয়ে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক ভাষা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের নবাব-জমিদার-নাইট-ব্যারিস্টারদের সাথে রাজনীতি করেও মওলানা ভাসানী ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির। তার সে রাজনীতি ছিল গরিব হিন্দু, গরীব মুসলমান, গরিব আদিবাসী কৃষক শ্রমিক মেহনতি মজলুম মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনীতি। এটি ছিল এদেশের গণ-মানুষের নিজস্ব ও নতুন ধারার রাজনীতি। পাশাপাশি মূল ধারার রাজনীতিতে তিনি আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। 

আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৪৭ সালে তাকে আসামের কারাগারে রেখে দেশভাগ হয়। আসাম হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সন্তোষে বসবাস আরম্ভ করেন। মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গণ-মানুষের ও নতুন ধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন।

কিন্তু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জনতার রাজনীতির পরিবর্তে ক্ষমতার রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তার তরুণ শিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়ারা মিলে মওলানা ভাসানী ও তার গণ-মানুষের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামুয়ালাইকুম’ জানানোর পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রকৃত নির্মাতা। ১৯৬৯ সালে স্বৈরাচারী আইয়্যুব শাহীর পতনের পটভূমি রচনার মধ্য দিয়ে তিনি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী-সহ সকল শ্রেণি পেশার জনগণকে সাথে নিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। এই আন্দোলনের ফসল গুণে অনেকেই যখন ক্ষমতার মসনদে বসার হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত, মওলানা ভাসানী তখন গভীর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত স্বাধীন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। তাই তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচন বয়কট করেছিলেন ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ বলে। আর বিপ্লবের দর্শন ও কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছিলেন তার ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে জরুরি কথা’ নিবন্ধে। এই বিপ্লবের লক্ষ্য সম্বন্ধে তিনি বলেন, ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন জনজীবনে এক নতুন আশার সঞ্চার করিবে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্য হইতেছে : সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণহীন, মহান সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা। এই লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা চলিতে থাকিবে।’ (ভাসানীর কথা, পৃষ্ঠা: ৪৬)

মওলানা ভাসানী ষাটের দশকের চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও তার বিপ্লব দর্শন ও কর্মপন্থা ছিল ভিন্ন। মূলত সেই ১৯২১ সাল থেকে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হুকুমতে রাব্বানীয়ার সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তিনি রবুবিয়াত বা পালনবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তার মতে, “রবুবিয়াত কোনো ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। তাই হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সকল মানুষের জন্য হুকুমতে রব্বানিয়া অর্থাৎ যে দেশে রবুবিয়াতের আদর্শ রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে কায়েম হইয়াছে, তাহা কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। মুসলমানদের জন্য যিনি রব বা পালনকর্তা, বিবর্তনকারী প্রভু, হিন্দুর জন্য তিনি একই বিধানে আলো-হাওয়া, ফল, পানি, বস্ত্র, খাদ্য সবই যোগাইতেছেন। একমাত্র রবুবিয়াতের আদর্শই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারে। (রবুবিয়াতের ভূমিকা (১৯৭৪); মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী)

মওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গুরুত্ব অনেকেই তখন অনুধাবন করতে পারেননি। কেউ কেউ না বুঝেই এর বিরোধিতা করেছেন। পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে এই বিপ্লব ছিল কমিউনিজম জ্বর, প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র; আর ভাসানীকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারকারী রাজনৈতিক উত্তরাধীকারদের কাছে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের পথে বড় বাধা। নাগরিক পরগাছা শ্রেণিভুক্ত বুদ্ধিজীবী ও এক শ্রেণির কমিউনিস্টরা প্রতিক্রিয়াশীলদের মতোই তার সেই বিপ্লবে সায় দেননি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের জাতিকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেনি। দুই দুইবার মানচিত্র আর পতাকার বদল হলেও শোষকের বদল হয়নি। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে নজরবন্দী থাকাবস্থায় মওলানা ভাসানীর দুইজন সফরসঙ্গীর একজন ছিলেন সিরাজগঞ্জের ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলামের সঙ্গে আলাপচারিতায় মওলানা ভাসানী তাকে বলেছিলেন, “চাইছিলাম লন্ডন যাব, প্রবাসী সরকার গঠন করব। কিন্তু কুটুম বাড়ি বেড়াইয়া গেলাম। অনেক বড় স্বপ্ন দেইখা দায়িত্ব কান্ধে নিয়া আমার সাথে আসছিলা। স্বপ্ন আমারও ছিল, বাংলার দুঃখী গরীব মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। সেটা পাইতে হইলে আর একটা লড়াই লড়তে হইবো। এতো রক্ত ঝরাইলো কিন্তু দ্যাশের মানুষ তো মুক্তি পাইবো না। আধা স্বাধীনতা নিয়া দ্যাশে ফিরলে আবার লাইগবো খটাখটি, তাই ভাইবতাছি----।” (স্বাধীনতা ভাসানী ভারত, সাইফুল ইসলাম)

১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী দেশে ফিরলেন। প্রথম রাত্রি কাটালেন সন্তোষের কুঁড়েঘরে খরের বিছানায়। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মওলানা ভাসানী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি পড়ে ফেলতে সক্ষম হলেন। শুরুতে আওয়ামী লীগকে দেশ গড়ার কাজে সহযোগিতার কথা বললেন। কিন্তু সহযোগিতার পরিবেশ না পেয়ে অচিরেই তিনি আওয়ামী লুটেরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বাধ্য হলেন। শেখ মুজিবকে কঠোর হস্তে ভারতীয় মারোয়াড়ি ও দেশীয় লুটেরাদের দমন করার আহ্বান জানালেন। ‘হক কথা’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা শুরু করলেন, যা পরবর্তীতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এলএফওর অধীনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিরোধিতা করলেন। কিন্তু আওয়ামী সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করলেন না। রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী দিয়ে বিরোধীদের প্রতি দমন-পীড়ন চালাতে লাগলেন। জনমতের কণ্ঠ রোধ করতে লাগলেন। সরকারি মদদে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করলেন। ৭৩ এর নির্বাচনে কারচুপি দিয়ে নির্বাচনের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করলেন। অতঃপর ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ এলো। মওলানা ভাসানী দুর্ভিক্ষকে মোকাবেলা করার জন্য সর্বদলীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক স্বাধীন দেশে গৃহবন্দী হলেন। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করে নিজের কফিনে নিজেই শেষ পেরেক ঠুকলেন। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন। তারপরের রাজনীতি কেবল ক্ষমতা আর প্রতিশোধকেন্দ্রিক হয়ে উঠল।

দেশ ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে মওলানা ভাসানী সবসময় ছিলেন আপোষহীন। না ভারতের প্রতি দুর্বলতা, না পাকিস্তানের পায়রবী। প্রয়োজনে চীনের নীতির তিরস্কার, মার্কিনীদের হুংকার, সোভিয়েতের সমালোচক এই হল মওলানা ভাসানীর নীতি। ভাসানীর সংগ্রাম ছিল শোষিতের জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত, জালেম আর মজলুম। জালেম হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক তার বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম চলবেই।’ (মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, পৃষ্ঠা: ৩৭) 

মওলানা ভাসানী মূলত গণ-মানুষের রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। যে রাষ্ট্র শাসনবাদী না হয়ে হবে পালনবাদী। ১৯৭৬ সালের ফারাক্কা লং মার্চের মধ্য দিয়ে তিনি এদেশে প্রাণ প্রকৃতি এবং পালনবাদী রাজনীতির প্রবল প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। দীর্ঘকাল সেই রাজনীতি সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও তরুণ প্রজন্মের নতুন বাংলাদেশের মধ্যে মওলানা ভাসানীর সেই পালনবাদী রাজনীতির প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী এই তরুণদের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে। কলকাতার ভাসানী গবেষক সৌমিত্র দস্তিদারের ভাষায়, “যত দিন যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু নয়, সারা দুনিয়ায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে ভাসানীর সময়, চিন্তা, লড়াইয়ের দর্শন নিয়ে। নিম্নবর্গের রাজনীতি থেকে গণআন্দোলনের ধারা, পরিবেশ আন্দোলন- সব আধুনিক ডিসকোর্সের পথিকৃৎ হিসেবে উঠে আসছে মওলানা ভাসানীর নাম।” (আমি ও আমার মওলানা ভাসানী, পৃষ্ঠা: ১০৪)

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ ডেভিড ল্যাডেন বলেছেন, ‘বিশ্বায়নের এই যুগ মওলানা ভাসানী দেখেননি, কিন্তু তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য এর অপার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য এবং গণতন্ত্রের জন্য ধর্ম-উৎসারিত নীতিবোধ, আবেগ-অনুভূতি এবং যুক্তি বিচারকে কাজে লাগিয়ে গণমানুষের আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব। কিন্তু দেখা গেছে, মূলধারার রাজনীতিকরা ধর্মকে ব্যবহার করেছে মানুষকে সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক লাইনে দ্বিধাবিভক্ত রাখতে। যাতে দরিদ্র অভিবাসী এবং তাদের প্রতিবেশীরা সংহতি গড়তে না পারে এবং ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম থেকে নিবৃত্ত থাকে। আটকে-পড়া বিহারীরা এই জন্যেই বাংলাদেশে জাতীয় শত্রু, ইউরোপে উত্তর আফ্রিকানরা, ভারতে বাঙালি মুসলমানেরা এবং যুক্তরাষ্ট্রে পৃথিবীর নানা অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীরা। তথাকথিত ‘সভ্যতার সংঘাত’ আসলে ধর্মভিত্তিক, যাকে কাজে লাগিয়ে শোষণ করা হয়েছে দরিদ্র মানুষদের; যাদের জন্য মওলানা ভাসানী এখনো এক আশার প্রদীপ।’ (সূত্র. মওলানা ভাসানী গ্রন্থ, পৃষ্ঠা. ৬৭ ও ৬৮)

মওলানা ভাসানী মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর। ইতিমধ্যে বায়ান্ন পেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতার বয়স তেপান্ন হলো। যে শোষণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, স্বাধীনতার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছিল তার অবসান হলো না। তেপান্ন বছরের পুঞ্জীভূত বৈষম্য, রাষ্ট্র ও নাগরিক গঠনের ব্যর্থতার জঞ্জাল সরানোর জন্য চব্বিশে এসে আমাদের তরুণদের আরেকবার প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ের প্রতিশ্রুত বাংলাদেশ গড়ার ব্যর্থতা চব্বিশের তরুণদের অবধারিতভাবে রাজপথে নামিয়ে দিল।

বিগত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ দেশের গণতন্ত্র, অংশগ্রহণের রাজনীতি, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার ও সুশাসন, সংবিধান ও সংসদসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করেছে। গুম, খুন, কারাগারে নিক্ষেপ; ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস দিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করেছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একটি গণ-বিরোধী দানবে পরিণত হয়েছিল; যেখানে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্কটি পরিবর্তিত হয়ে প্রজা ও দাস প্রথার মতো আচরণ করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার ও ভিন্নমত পোষণকরীকে দানবীয় কায়দায় দমন করা হয়েছে। মোটকথা এই রাষ্ট্রটি হয়ে উঠেছিল একটি পরিবারের সম্পত্তি আর সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে লুটেরা উন্নয়নের স্বপ্নবানে জর্জরিত করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ফ্যাসিবাদ।

আওয়ামী দুঃশাসন ও ফ্যাসিবাদী নৃশংসতা চব্বিশের জেনারেশনকে দমাতে পারেনি। তারাই চিনিয়ে দিয়েছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়ামী লীগ নয়। অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগও নয়। লুটেরাদের অর্থনীতি আর পারিবারিক রাজনীতি টিকিয়ে রাখতেই তাদের এই চেতনা ব্যবসা। চব্বিশের তরুণেরা তাদের রক্তচক্ষু আর বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার পটভূমি রচনা করে দিয়েছে। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ঈমন, মারুফরা জীবন দিয়ে আমাদের জাগ্রত করেছে। আমরা তাদের এই আত্মত্যাগ আর স্বপ্ন বেহাত হতে দিতে পারি না।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও নাগরিক গঠনে যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবিধান বা শাসনতন্ত্র পেতাম, তাহলে বোধকরি এমন বৈকল্য আমাদের দেখতে হতো না। বারবার স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন করতে যেয়ে জনগণকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হতো না। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন সঙ্কট ও সম্ভাবনা আমাদের দুয়ারে হাজির। দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ ভাগ, যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলিত রূপকেই আমরা ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলছি। যারা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে গণসার্বভৌমত্তের বাংলাদেশ গড়তে চায়। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি অন্বেষণের মাধ্যমে বিউপনিবেশিক রাজনৈতিক তৎপরতা বা ধারা বিনির্মাণ করতে চায়। যেখানে শোষণ ও বৈষম্য থাকবেনা। এই পথ বন্ধুর, কিন্তু অজেয় নয়।

মওলানা ভাসানী তার জীবনের শেষ ভাষণে বলেছিলেন, “যে কৃষক-মজুর-কামার-কুমার-জেলে-তাঁতী-মেথর প্রভৃতি মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন আবাল্য দেখিয়াছি ও সেজন্য সংগ্রাম করিয়াছি, তাহা আজও সুদূর পরাহত রহিয়া গিয়াছে। তাই আমার সংগ্রামের শেষ নাই।” (ভাসানীর কথা, পৃষ্ঠা:১৪১) আমার দৃঢ় বিশ্বাস মওলানা ভাসানীর সেই সংগ্রামের উত্তরাধিকার চব্বিশের তারুণ্য। আর তাদের সামনে একটাই পথ ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ।

লেখক: আজাদ খান ভাসানী, সদস্য সচিব, ভাসানী পরিষদ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh