গুজবের মনস্তত্ত্ব ও রাজনীতি

গুজবের আভিধানিক অর্থ ‘জনরব’ বা ‘ভিত্তিহীন প্রচার’। এই ভিত্তিহীন প্রচার এতটাই শক্তিশালী, যা যেকোনো সময় যেকোনো দেশে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। গুজব মূলত মজাদার, মুখরোচক ও শ্রুতিমধুর বিষয়। তবে গুজবের দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক তাৎপর্যও রয়েছে। গুজব অনেক ক্ষেত্রে ‘ভুল তথ্য’ এবং ‘অসংগত তথ্য’ এই দুই বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

‘ভুল তথ্য’ বলতে মিথ্যা ও বানোয়াট বোঝায় এবং ‘অসংগত তথ্য’ বলতে ইচ্ছাকৃতভাবে ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা বুঝায়। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত রবার্ট এইচ নাপ তার ‘এই সাইকোলজি অব রিউমার’ প্রবন্ধে গুজবকে কেন ছড়ানো হয় অথবা গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি ভ্রান্ত আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছড়ানো গুজবকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন :  পিপ ড্রিম রিউমার : এটি মূলত ছড়ানো হয় ভালো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। এই শ্রেণির গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি চান গুজবটি যেন সত্যি হয়। কারণ এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে থাকে ভালো কোনো উদ্দেশ্য। ভগি বা ফিয়ার রিউমার : এটি সাধারণত ছড়ানো হয় সমাজে আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। ওয়েজ ড্রাইভিং অ্যাগ্রেশন রিউমার : মূলত এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে।

গুজবের প্রাথমিক কাজ হলো এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে মানুষের পরিষ্কার ধারণা নেই, কিন্তু আগ্রহ আছে। গুজবে এ ধরনের তথ্যই বেছে নেওয়া হয়, যেখানে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ রয়েছে।

গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সাইকোলজি অব রিউমার’ গ্রন্থে গুজব ছড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বর্ণনা করেছেন। যেমন- পরিস্থিতি যখন অনিশ্চিত তখন মানুষ গুজব ছড়ায় বা গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আবার মানুষ যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে, তখনো গুজব ছড়ায় বা গুজবকে গ্রহণ করে। উদ্বেগের সঙ্গে অনিশ্চয়তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষের মধ্যে বেশি উদ্বেগ কাজ করে, তারাই বেশি গুজব ছড়ায়। গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে, খারাপ কোনো ঘটনার গুজব ভালো ঘটনার গুজবের চেয়ে দ্রুত ছড়ায়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অর্থাৎ রটনাকারী যখন জানে যে এই বিষয়ে তথ্যগুলো মানুষ জানতে চায়, অর্থাৎ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তখনই তা ছড়ায়। আর যারা গুজব ছড়ায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা সেটা বিশ্বাস করে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।

এ ছাড়া অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা অন্যকে নিচু করতেও গুজব রটানো হয়। সামাজিক অবস্থানকে শক্ত করতেও অনেকে গুজবের আশ্রয় নেয় বলে গবেষকদের মত। তবে গর্ডন অলপোর্ট ও লিও পোস্টম্যান গুজবের জন্য মূলত মানুষের ডিএনএকে দায়ী করেছেন। যেসব জাতির গুজবে পরম আস্থা ও অভ্যস্ত, তাদের জিন বা বংশগতির নিয়ন্ত্রক উপাদান খুঁজে দেখা জরুরি বলে তারা মনে করেন। কোন প্রজাতি থেকে তাদের উৎপত্তি! কোনো জাতির যৌথ আচরণ নিয়ে গবেষণা করতে হলে তার চরিত্রের আদি নিয়ন্ত্রক উপাদানের সন্ধান করা প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ বাঙালির গুজব প্রবণতার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বাঙালির জীবকোষের সংকেত বিশ্লেষণ করলে, তার ডিএনএ পরীক্ষা করলে দেখা যাবে তার পূর্বপুরুষ ছিল নিশ্চয়ই ‘উল্লুক প্রজাতির’। তার মতে, ‘কোনো জাতির সবচেয়ে মেধাবী মানুষটি এবং সবচেয়ে নির্বোধের মধ্যেও একটি মিল থাকে’। গুজব নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা প্রথমেই জনগোষ্ঠীর সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। কোনো কোনো সমাজের মানুষ গুজব তৈরি করে এবং প্রচার করে অপার আনন্দ লাভ করেন। মূলত অনগ্রসর সমাজ ও রাষ্ট্রে গুজব বেশি ছড়ায়। কারণ এসব সমাজে জনসাধারণের শিক্ষার হার কম এবং সঠিক তথ্য প্রাপ্তিরও ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং সংবেদনশীল কোনো বিষয়ে গুজব ছড়ানো এসব সমাজে সহজ হয়।

অন্যদিকে যে সমাজে আবেগ ও বিশ্বাসপ্রবণতা বেশি; গুজব সেই সমাজেও বেশি ছড়ায়। বাংলাদেশের মানুষ প্রচণ্ড আবেগ ও বিশ্বাসপ্রবণ। শোনা কথা ও ধারণাপ্রসূত কথা শোনা ও বলায় তাদের আগ্রহ অনেক বেশি। আর এই অতি আগ্রহের কারণে গুজব ছড়ানো অনেক সহজ হয়। বিভিন্ন স্বার্থাণ্বেষী মহল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়। 

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে দেশে-বিদেশেও নানা গুজবের উৎপত্তি দেখেছি, দেখছি; যা কখনো কখনো মব উসকে দিয়েছে, কখনো নানা অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, করে চলেছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই অবাধ ব্যবহারের সময় গুজব ছড়ানো খুব সহজ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গুজবের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য পূরণে তৎপর হয়ে উঠেছে। গুজব মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ছড়ানো হয়। তা ছাড়া গুজব সৃষ্টির একটি পটভূমি থাকে। যে সমাজে সত্য অনুপস্থিত এবং মিথ্যার প্রাধান্য, অথবা সত্য গোপন করার প্রবণতা খুব বেশি, সেখানে গুজব বেশি ছড়ায়।

তবে গুজবের   রাজনীতি যখন দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অস্থিরতা সৃষ্টি করে, তখন একে শক্ত হাতে দমন করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। গুজব প্রতিরোধে স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশের পাশাপাশি কিছু প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রযুক্তিবিদরা এই বিষয়ে কাজ করতে পারেন, যাতে কেউ কোনো গুজব অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করতে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা লকড হয়ে যায়। বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম ইউনিট এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে এর আগে কাজ করেছে। ফেক নিউজ চিহ্নিত করার অ্যাপস সহজলভ্য করা। এখন ফেক নিউজ চিহ্নিত করার জন্য অনেক অ্যাপস তৈরি হয়েছে, যেগুলো স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে ইনস্টল করা গেলে গুজব ছড়ানো রোধ করা সম্ভব।

সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তাই বলে দেশের স্বার্থে গুজব দমনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে কার্পণ্য করা ঠিক হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh