বদরুদ্দীন উমরের ৯৩তম জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

আমাদের গর্বের বিষয় হচ্ছে আমরা বদরুদ্দীন উমরের ৯৩তম জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারছি। ক্ষণজন্মা এ রকম একজন প্রাণপুরুষের জন্য আমাদের শ্রদ্ধা ও গর্বের শেষ নেই। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম, তিনি এখনো সক্রিয় এবং জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে এ দেশের জনগণের মুক্তির পথ একনিষ্ঠভাবে দেখিয়ে যাচ্ছেন। কাজটি তিনি ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পদ থেকে ইস্তফা এবং ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছেন। 

বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানার সবচেয়ে উপযুক্ত ও কার্যকরী তথ্য হচ্ছে তার লিখিত পাঁচ খণ্ডের আত্মজীবনী, যা ‘আমার জীবন’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। এ রকম বৃহৎ ও বিশাল ক্যানভাস নিয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত আর দ্বিতীয় কোনো আত্মজীবনী লেখা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এটি তার জীবন কাহিনিই শুধু নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে ঘটিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির বর্ণনাই নয়, আছে সেসব ঘটনাবলির বস্তুনির্ভর বিশ্লেষণও। সে কারণে এই আত্মজীবনীটি একটি ঐতিহাসিক দলিলও হয়ে গেছে।

বদরুদ্দীন উমর একক প্রচেষ্টায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ওপর গবেষণামূলক গ্রন্থের মাধ্যমে এ দেশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বকে প্রথম তথ্য-উপাত্তসহ তুলে ধরেছিলেন। এর আগে পর্যন্ত বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন এ দেশের মানুষের কাছে ঢাকার শহীদ মিনারে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ফুল দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আজ আশ্চর্য হতে হয়, এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিষয়ে জানা-বোঝার ক্ষেত্রে দেশের ঐতিহাসিকসহ বুদ্ধিজীবী মহলের কেন আগ্রহ ছিল না। তিন খণ্ডে লিখিত সেই গ্রন্থে তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় এবং তার আগে-পরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত জীবিত সব নেতারই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেগুলোর ঘটনা ও সময়ের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য ক্রস চেকও করেছিলেন। ফলে তার বর্ণনা ও বিশ্লেষণের বিষয়ে ২০০৯ সালের আগে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এ দেশের সব ঘটনাই যে তার পিতার নেতৃত্বে হয়েছিল সেটি প্রমাণ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যান। সে কারণে ২০০৯ সালের পর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বদরুদ্দীন উমরের নাম ধরে ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখা তার গ্রন্থের এক তরফা সমালোচনা করতেন। কিন্তু তিনি তার মোসাহেব বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্যসহ পাল্টা গ্রন্থ লেখাতে পারেননি।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালে বদরুদ্দীন উমরের তিনটি গ্রন্থ যথাক্রমে সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট এবং সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা নামক গ্রন্থগুলো পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান মধ্যশ্রেণির ধর্ম ও জাতীয়তা সম্পর্কে ধোঁয়াশা ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। সে কারণে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে তার ভাষায় ‘বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’টা বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এ দেশের মানুষের দ্বারা তখন জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশ গঠনের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচিত হয়। এতে পাকিস্তান সৃষ্টির দার্শনিক ভিত্তির মূলে এই প্রথম শক্তিশালীভাবে আঘাত হানে।

১৯৬৯ সালে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পর থেকে প্রথমে সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’ এবং পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সাল থেকে তাত্ত্বিক পত্রিকা ‘সংস্কৃতির মাধ্যমে এ দেশের বামপন্থীদের ভুলভ্রান্তির বিরুদ্ধে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। একই সঙ্গে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে শাসকশ্রেণিভুক্ত সব রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের এবং তাদের শ্রেণি চরিত্রকে তুলে ধরে বিশ্লেষণধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের বিতর্ক এ দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। কিন্তু এসব বিতর্কে অংশ নিয়ে সেসব তাত্ত্বিক প্রশ্নগুলোকে নিজেদের বক্তব্যতে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেননি। ফলে বামপন্থীদের তত্ত্বগত অবস্থানের ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার অভাব আর দূর হয়নি। এর প্রধান কারণই হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের জন্য তাদের নিজের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং ইতিহাস সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞানের অভাব। এই অভাবের জন্য তারা চীন-রাশিয়াকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে এদের রণনীতি ও কৌশল বাস্তবতাবিবর্জিত হয়ে যায়।

মার্কসবাদ এমনই একটি দর্শন, যা শুধু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। বিশ্বের সব দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে মার্কসীয় মতবাদের মৌলিক পার্থক্য আছে। মার্কসীয় দর্শন শুধু দর্শনই না, এটি সমাজ পরিবর্তনে বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার।

মার্কসবাদীরা সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য প্রথমেই তাদের নিজ দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার কাজটাও নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকেন। আমরা রাশিয়া ও চীনের বিপ্লবের উদাহরণ থেকে এই বিষয়গুলো জানতে পারি। লেনিন রুশ বিপ্লবের আগে রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক সমস্যা এবং সেই সমাজের শ্রেণি দ্বন্দ্ব ছাড়াও ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে কত গভীরভাবে অধ্যায়ন করেছিলেন, সেটা তার রচনাবলি থেকেই জানা যায়। একইভাবে মাও সেতুং-এর রচনাবলির থেকেও চীন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার গভীর মূল্যায়নের বিষয়গুলো থেকেও শিক্ষা লাভ করা যায়। এভাবে যেসব দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়েছে তাদের তত্ত্বগত জ্ঞান এবং এসব দেশের ইতিহাস, তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ওপর গভীর জ্ঞানের চর্চার বিষয়গুলো আমরা জানতে পারি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মার্কসবাদীদের এ ক্ষেত্রে কেন তেমন কোনো অবদান নেই। এ দেশের বামপন্থীরা কেন এ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেননি? বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতিকে জানা না গেলে কীভাবে এ দেশের সামাজিক বিপ্লব হবে? এই অভাব পূরণের জন্যই এককভাবে বদরুদ্দীন উমর যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে তত্ত্বগত চর্চা এবং বিতর্কের প্রয়োজনীয়তাকে বারবার উল্লেখ করেছেন, সেটা এক অর্থে অসাধারণ। ১৯৭০ সালে ভাষা আন্দোলনের ওপর তার গবেষণামূলক গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি এ দেশে ইতিহাসচর্চা শুরু করেন। কিন্তু এ দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে জানার জন্য তিনি কখনো থেমে যাননি। ধারাবাহিকভাবে এই ৯৩ বছর বয়সেও সেই চর্চা তিনি করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ The Emergence of Bangladesh হচ্ছে এ পর্যন্ত লিখিত বদরুদ্দীন উমরের সর্বশেষ ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ। দুটি খণ্ডে লিখিত এই গ্রন্থের মধ্যে ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক-শ্রমিক তথা সব শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের বিস্তারিত বিবরণ এবং তার মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে এ দেশের শ্রেণি-সংগ্রামকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তিনি তুলে ধরেন। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত না হলে এ দেশের মানুষ ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস আর জানতে পারত না। এখানে যেসব তথ্য এবং সংগ্রামের বিবরণকে তিনি প্রকাশ করেছেন- এটা শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের প্রতি দৃঢ় আস্থা এবং শ্রদ্ধা থাকার ফলেই যে সম্ভব হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই খণ্ডের এই গ্রন্থ প্রথমে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলেও ‘বাঙলাদেশের অভ্যুদয়’ নামে এর বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তার ওপর ভিত্তি করে বদরুদ্দীন উমর ১৯৭২ সালের পর থেকে উল্লেখ করে আসছেন, এ দেশের সব রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং সমাজের পরিবর্তনের জন্য গণ-অভ্যুত্থানের বিকল্প কোনো পথ নেই। তথাকথিত সাংবিধানিক এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রকৃত মুক্তি অর্জিত হতে পারে না। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান তার বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রমাণ করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি বৃহত্তর গণ-অভ্যুত্থান যা জনযুদ্ধে রূপ নেয়। কিন্তু সেই জনযুদ্ধের পরিসমাপ্তি আওয়ামী লীগের মতো উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তি ভারত সরকারের সাহায্যে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। বিষয়টি ঐতিহাসিক সত্য হলেও এ দেশের ঐতিহাসিকরা তা সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানের গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সেই সংবিধানের বিভিন্ন ধারার মধ্যকার সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো ১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধান রচিত হওয়ার পর থেকেই বদরুদ্দীন উমর যেভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেগুলো যে কত সঠিক ছিল তা আজকে ৫ আগস্টের পর সংবিধানবিষয়ক বিতর্ক থেকে প্রমাণ হয়ে গেছে। তিনিই প্রথম উল্লেখ করেছিলেন ১৯৭০ সালের পাকিস্তান গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নের জন্য যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের দ্বারা কীভাবে নতুন স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। উচিত ছিল নতুন করে সংবিধান সভার নির্বাচন করা। কিন্তু সেটি না করে একতরফাভাবে দু-তিনজন বাদে আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে যে সংসদ ১৯৭২ সালে গঠিত হয়, তাদের দ্বারাই মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। সেই সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যে পরস্পরবিরোধী, সেটি বদরুদ্দীন উমর সংবিধানের খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পরপরই উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়া সেই সংবিধান চূড়ান্ত হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের মধ্যে যেসব সংশোধনী আনা হয়, তার পরিণতিতে যে দেশে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে, তাও উল্লেখ করেছিলেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রমাণিতও হয়েছিল।

এভাবে দেখা যায়, বদরুদ্দীন উমর তার প্রতিভাকে সব সময় এ দেশের জনগণের মুক্তির পথ দেখাবার কাজেই ব্যবহার করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টার বিষয়ে প্রশ্ন করার উপায় নেই। যদিও তিনি সব সময়ই তার কর্মের সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছেন, বিতর্ককে সব সময় উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তার এই আহ্বানে তেমন সাড়া না পাওয়াতেও তিনি হতাশ হয়েছেন। 

বাংলাদেশের ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানার তাগিদ থেকে উনিশ শতকে বাংলার সমাজকে দেখার জন্য যে কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন, সেগুলোর তাৎপর্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তার প্রতিটি জ্ঞানভিত্তিক চর্চার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বস্তুনিষ্ঠতা এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের মতো একটি দেশে প্রকৃত অর্থে লোভ-লালসাহীন এবং সুযোগ-সুবিধাকে পদদলিত করে এগিয়ে যাওয়ার লোকের অভাবের মধ্যে বদরুদ্দীন উমর একজন অভাবনীয় ব্যক্তিত্ব। আমরা তার ৯৩তম জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা এবং সক্রিয় জীবন কামনা করছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh