রাজনৈতিক দলের হাতছাড়া হয়ে গেছে রাজনীতি

আমাদের জাতীয় রাজনীতি দেশের রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। এখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা শিক্ষা, শিক্ষানীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলছেন। আমি আগেও বলেছি, সব সময় বলি, একটা দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভালো হলে এসব সম্ভব। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া সামরিক বা অন্য কোনোভাবেই নিজের জাতির যে ইতিহাস, ঐতিহ্য বা অন্য কোনো সম্ভাবনা বা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এখন উপদেষ্টা পরিষদের যারা সদস্য, তারা সবাই পরীক্ষার ফল বিচারে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। আরো নানা কৃতিত্ব তাদের পরবর্তী জীবনে আছে।

যেহেতু তারা ভালো ছাত্র এবং নানা গুণের অধিকারী, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক নানা অবস্থানের বিচারে তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। এই রকম উপদেষ্টামণ্ডলী এখন আমাদের। কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় গুরুতর কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন, তাতে নানা রকম ভুলভ্রান্তি হয়। সেই ভুলভ্রান্তির আশঙ্কা আমাদের বর্তমান উপদেষ্টামণ্ডলীরও আছে। তবু তারা কিছু বিষয় সংস্কার করার ঘোষণা দিচ্ছেন।

কিন্তু আমি বলব, এসব ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য এই সরকার যথেষ্ট নয়। একটা অন্তর্বর্তী খারাপ অবস্থা থেকে ভালো অবস্থায় যাওয়ার জন্য মাঝখানে যে ট্রানজিশন পিরিয়ড, এই সময়ে তারা কিছু সংস্কার করতে চান। কিন্তু এই সংস্কার করার জন্য যেসব কমিটি গঠন করেছেন, সেগুলোর পরিধি বিশাল। যেগুলো আসলে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই করা উচিত। এটাই আমার আপাতত ধারণা। 

তবে একটা ভালো ব্যাপার এই যে উপদেষ্টামণ্ডলীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছেন না। এমনকি জনসাধারণের মধ্যেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি যেভাবে দেশ শাসন করেছে, তার প্রতি জনসাধারণের একটি বিরূপ মনোভাব, অশ্রদ্ধা আছে। তাদের গোটা রাজনীতিকেই বাতিল করে দিয়ে মানুষ কথা বলছে। রাজনীতি এবং তাদের নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সাধারণ মানুষের যে বিরূপ ধারণা, এই মনোভাব আমাদের গোটা জাতির জন্যই একটি ক্ষতির কারণ। রাজনৈতিক দল এবং নেতৃত্ব ছাড়া এসব অবস্থায় থেকে ভালোর দিকে যাওয়া সম্ভব নয়। সাময়িকভাবে কিছুটা ভালো হয়তো আমরা দেখতে পারব। যেমন- ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ আমাদের আরো বেশি ঋণ দিচ্ছে, কিন্তু ঋণের যে সদ্ব্যবহার, সেটা কি আমরা করতে পারছি?

কেবল খেয়ে বাঁচা বা বেতন-ভাতা দেওয়া এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তো আমাদের চলবে না। গোটা জাতির জন্য কী কী ভালো কাজ আমাদের দরকার, সেগুলো করার দিকে আমরা কতটা এগোচ্ছি, এসব বিষয়ে নিজেদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই বোঝা এবং করা সম্ভব।

অরাজনৈতিক, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের যে ব্যবস্থাটা চালু হয়েছে, তা তো আমাদের দেশের কোনো রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবী কারো মাথা থেকে আসেনি। কথাটা এসেছে অন্য কোনো শক্তির মাধ্যমে। এরশাদ সরকারের আমলে বলা হতো ডি পলিটিসাইজ করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। বাংলায় লিখলে বিরাজনীতিকরণ অথবা নি-রাজনিতীকরণ। দুটি আসলে একই অর্থ বহন করে, কোনো পার্থক্য নাই। এই ডি পলিটিসাইজেশন, এটা তো এখন বাংলাদেশে হয়ে গেছে। আমি আমার লেখা এবং বক্তৃতায় বহুবার বলতে এবং বোঝাতে চেয়েছি, রাজনীতির মাধ্যমেই আমাদের রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান করতে হবে। অন্য কোনোভাবে নয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের ব্যাপারে আমাদের কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের নানাবিধ সম্পর্ক আছে, তা নিয়ে যুক্তিপূর্ণভাবে এগোতে হবে। একই কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজের দেশ শাসন করেই সন্তষ্ট নয়। তারা গোটা পৃথিবীর উপর শাসন চালাতে চায়। কর্তৃত্ব, আধিপত্য খাটাতে চায়। পৃথিবীময় তারা যুদ্ধের উসকানি দিয়ে চলেছে। একটা পক্ষকে সহযোগিতা এবং আরেকটি পক্ষকে বিরোধিতা করে তারা তাদের অস্ত্র বিক্রির একটা বাস্তবতা তৈরি করে এবং যুদ্ধ যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় তার আয়োজন করে। এই যেমন মধ্যপ্রাচ্যে এখন যুদ্ধ চলছে, এত মানুষ মরছে, এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে পরিস্থিতি অন্য রকম হয়ে উঠত। এই যে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে বিরোধ- এটা জটিল করার জন্যও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং এই ধারার লোকেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, উসকানি দিয়েছে।  আমার মনে হয় রাশিয়ার জন্য ভুল হয়েছে এই ফাঁদে পা দিয়ে। কারণ পুতিন বুঝতে পারেনি যুদ্ধটা রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।

অন্যদিকে শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক রেখেছিল, তাতে তারা একান্তভাবেই ক্ষুব্ধ ছিল এবং সরকারের পতনের পেছনে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে তা পদত্যাগের দিন বা তার আগের দিন শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি আগে বলেছিলাম জামায়াত-বিএনপি এর পেছনে আছে। আমার ধারণা আসলে ভুল ছিল। আমাদের সরকার উৎখাত করতে চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।’ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটিকে গুরুত্ব দিয়েও আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বিচার করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এখন আরো বেশি বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ন্ত্রণে, পরিচালনায় এসে যাচ্ছে। ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আরো নানা টিম এসে বর্তমান সরকারের নানা বিভাগের সঙ্গে দেখা করছে। পরামর্শ দিচ্ছে- কী করতে হবে বা না করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব না দিয়েই তারা কথা বলছে। তারা অতীতেও কখনো কখনো এসব করেছে। 

এই দুর্বিপাকের মধ্যে উপদেষ্টামণ্ডলীর সবাই প্রতিই আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ আছে। অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও আছে। কিন্তু  তারা যে ঘোষিত লক্ষ ও উদ্দেশ্যগুলো নিশ্চিতভাবেই পূরণ করতে পারবেন এটা এখনো বলা যায় না। তবে আমরা চাই তাদের সাফল্য। তাহলেই দেশ ভালোর দিকে যাবে। এ জন্য নতুন করে রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। আওয়ামী লীগ আগের মতো চিন্তা ও কাজ নিয়ে আসতে পারবে না। আসতে হলে তাদের নতুন রাজনীতি, সময়ের চাহিদা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থা বিবেচনা করেই আসতে হবে। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা। আগের চিন্তা বাদ দিয়ে নতুন বাস্তবতা বুঝেই তাদের রাজনীতি করতে হবে। 

জামায়াতের ব্যাপারে আমি বলব, হিংসা- প্রতিহিংসা এটা কারো ব্যাপারেই কাম্য নয়। মানুষের ভুলত্রুটি হতে পারে। তবে তা স্বীকার করে ভালোর দিকে যাওয়ার লক্ষ্য থাকা উচিত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পক্ষ-বিপক্ষের  পাল্টাপাল্টিই চলছে, রাজনীতির উন্নতি হচ্ছে না। আমরা এই অবস্থার অবসান চাই। মানুষ ভালো কাজ করে, খারাপ কাজও করে। যে মানুষ একসময় খুব খারাপ কাজ করে, সময়ান্তরে সেও হয়তো ভালো কাজ করে। জামায়াতে ইসলামী তো এখন মুসলিম লীগের মতো দল হয়ে গেছে। তারা এখন জিহাদের কথা বলে না। বরং মুসলিম লীগের মতোই গণতন্ত্রের কথা বলে। 

সবশেষে বলব রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠুক, এটা চাই। বর্তমানে যেসব রাজনৈতিক দল আছে, রাজনীতি তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। অরাজনৈতিক, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ধারায় চলে গেছে দেশ। রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভুলের ধারায় চললে যে অবস্থা হয়, বাংলাদেশে এখন সেই অবস্থা চলছে। কিন্তু এই ধারা দিয়ে দেশের মঙ্গল হবে না। স্বাধীনতা রক্ষা পাবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh