কাজী জহিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২৯ পিএম
আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩২ পিএম
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। যার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আন্দোলনটি তুঙ্গ স্পর্শ করে, তিনি এই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক আবু সাঈদ। জুলাই মাসের ১৬ তারিখে, দিনের আলোতে, পুলিশের উদ্যত রাইফেলের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘গুলি করলে কর’। তিনি হয়তো ভাবেননি, নিজের দেশের পুলিশ দিনের আলোতে সামনাসামনি একজন নিরস্ত্র ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করতে পারে! অথবা তিনি জানতেন, তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রাণের স্বদেশ স্বৈরাচার মুক্ত হবে, এই মহিমান্বিত মৃত্যুর কথা লেখা থাকবে এ দেশের প্রতিটি দেয়ালে, সব মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে, আবু সাঈদ নিজেই হয়ে উঠবেন ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের প্রধান প্রতীক।
১৮ তারিখে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব হয়ে যায় একটি পেনসিল স্কেচে। ছবিটি শেয়ার করেন নাট্যপরিচালক মাবরুর রশিদ বান্না। তিনি লেখেন, ছবিটি এঁকেছেন ভারতের অংকন শিল্পী কৌশিক সরকার। দুই হাত প্রসারিত শহীদ আবু সাঈদের সেই ছবি দেখার সঙ্গে সঙ্গে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। প্রকাশিত খবর তন্ন তন্ন করে খুঁজি, দেশে যেসব বন্ধু-আত্মীয় আছেন, তাদের ফোন করি। নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবু সাঈদের কিছু ছবিও পেয়ে যাই। এসব করতে করতে ১৮ তারিখ সারা দিন কেটে যায়। অনেক বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয় আমাকে অনুরোধ করেন, কিছু একটা করেন, কিছু একটা লেখেন। দেশের সো-কল্ড বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক সবাই তো নীরব ভূমিকা পালন করছেন, আপনি কিছু একটা লিখুন, আপনি একটি কবিতা লিখলে আন্দোলন অনুপ্রেরণা পাবে।
সারা রাত ছটফট করি। তখনো হয়তো ভোরের আলো ফোটেনি। বিছানা থেকে উঠে বাতি জ্বালাই। সেলফোনের মেমো অপশনে গিয়ে লিখি, ‘তার প্রসারিত দুই বাহু ছিল একটি উড়ন্ত পায়রার মত বুকে তার অসীম সাহস, ভালোবাসার বারুদে ঠাসা ছিল সেই বুক কী বন্ধু কী অচেনা নিন্দুক সকলের জন্যে ছিল অবারিত ভালোবাসা সে ছিল একটি উজ্জ্বল প্রত্যাশা একটি নতুন সকালের স্বপ্ন...’
এইটুকু লিখেই থেমে যাই। আমার দুই চোখে তখন মেঘনা-যমুনা। আমার স্ত্রী মুক্তির ঘুম ভেঙে যায়। হার্টের অসুখে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর ঘুমের অনিয়ম করি না। ডাক্তার বলেছেন, পরিমিত ঘুম আমার হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য খুব দরকার। এ জন্য এখন রাত ৯টার পরে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিই না, সন্ধ্যার পরে বাইরে যাই না, রাতে মুভি দেখার অভ্যেস বাদ দিয়েছি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে অটিস্টিক মেয়েকে স্কুলের জন্য তৈরি করার কাজটি এখন আমার স্ত্রী একাই করেন। মুক্তি চোখ খুলেই বলে, বাতি জ্বালিয়ে কী করছ? আমি কথা বলতে পারি না, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। কিছু না বলে টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। বুকের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা, ঘুমানোর তো প্রশ্নই ওঠে না।
সেদিন ছিল শুক্রবার। মেয়েকে তৈরি করার জন্য মুক্তি উঠে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমিও উঠে পড়ি। আবার লেখার চেষ্টা করি। কিন্তু কবিতাটিতে যাবার আগে স্মার্ট ফোনের স্ক্রিন স্লাইড করে ঢুকে পড়ি ফেসবুকে। ততক্ষণে আবু সাঈদকে নিয়ে বহু পোস্ট, ভিডিও চলে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমার চেনা-জানাদের মধ্যে বেশির ভাগই কবি, লেখক, সাংবাদিক। তারা সবাই নীরব। এই বিষয়ে তাদের কারো টাইমলাইনে কিছু নেই, এমনকি অন্যের পোস্টেও কমেন্ট নেই। আমি যারপরনাই হতাশ হলাম জাতির বিবেক বলে পরিচিত সেই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততা দেখে। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পদক, পুরস্কার দিয়েছে, নানান পদ দিয়েছে, তাই বলে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যাবে না? আমি ভালো করে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ ছবিটি দেখার চেষ্টা করি। দেখি ওর ডান হাতে ছোট্ট এক লাঠি। তখনই এই কবিতার পরের লাইনগুলো লিখে ফেলি, ‘তার ডান হাতে ছিল একটি প্রতীকী লাঠি,/এই অন্ধ সমাজের হাতে/উদ্দীপ্ত যুবক তুলে দিতে চেয়েছিল ছোট্ট এক ন্যায়দণ্ড।’
এইটুকু লিখে মনে হলো, ওর পরিচয়টা ভালো করে জানা দরকার। বয়স কত? কোন বিষয়ে পড়ত। কোনো ভিডিও কি আছে? লুটিয়ে পড়ার সময় কেমন ছিল ওর মুখের অভিব্যক্তি? এমন হাজারো প্রশ্ন আমার মাথায়। আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে সময় আমাদের এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, এখন তথ্য খুঁজে পেতে অনেক সংবাদপত্রের পাতা উল্টাতে হয় না, গোয়েন্দা বিভাগকে ফোন করতে হয় না, প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলতে হয় না। হাতের সেলফোনটিই অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেয়। কয়েক মিনিট সার্চ করেই জেনে যাই ওর বয়স, কিন্তু কোন বিষয়ে পড়ত তা তখনো জানতে পারিনি। তবে একটি ভিডিও পাই, যেখানে দেখি চারটি গুলি লাগার পরেও ও লুটিয়ে পড়েনি, তখনো অনড় দাঁড়িয়ে থেকে দুই হাত প্রসারিত করে নিজের বুকটা এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য পেতে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তখন সকাল হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে, ফজরের কাজা নামাজ পড়ে লিভিংরুমে নেমে আসি। ব্রেড টোস্ট করি, ডিম পোচ করি, চায়ের পানি গরম করি। খাবার সরিয়ে রেখে আবার কয়েকটা লাইন লিখি, ‘তেইশ বসন্তে বেড়ে ওঠা ওর দীর্ঘ ঋজু দেহ/পুলিশের গুলিতে তখনও লুটিয়ে পড়েনি,/ অনড় দাঁড়িয়ে আছে/ভূমি থেকে বর্ষার আকাশ অব্দি ব্যাপ্তি নিয়ে/নতুন প্রজন্মের এক বাংলাদেশ।’
খুব কমই আমার এমন হয় যে একটি কবিতা আমি একটানে লিখে শেষ করি না। কিন্তু এই কবিতাটি লিখতে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছি কেন? বারবার একটি বিশাল প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়, এটা কী করে সম্ভব পরিষ্কার দিনের আলোতে একজন নিরস্ত্র যুবকের বুকে নিজের দেশের পুলিশ বন্দুক তাক করে গুলি ছুড়ছে? ভিডিওতে দেখা দৃশ্যটি মনে হতেই বুকটা হু হু করে ওঠে। আমার ছেলে অগ্নি ওর চেয়ে কয়েক বছরের বড়, এই ছেলেটি তো আমার ছেলেও হতে পারত।
দুপুরের দিকে আবার কয়েক লাইন লিখি, ‘উদ্বেল দু’হাত প্রসারিত জল্লাদের প্রতি,/একটি নতুন সকালের যাত্রী হতে ডেকেছিল তাকে,/যে অনিন্দ্য ভোরের রক্তিম সূর্য আর কিছুক্ষণ পর/ তারই বক্ষ ফুঁড়ে উঠে আসবে আকাশে,/জল্লাদ পুলিশ তখনও বোঝেনি/ক্রমাগত গুলি ছুড়ছে সে বাংলাদেশের বুক লক্ষ্য করে’, এরপর ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করি। খুব তাগিদ অনুভব করি, নান্দনিক দিক থেকে যদি দুর্বলও হয় তবুও কবিতাটি লিখে শেষ করতে হবে এবং ফেসবুকে পোস্ট করতে হবে। এটিকে আর বেশি বড় করবার দরকার নেই, বরং এই মুহূর্তে দরকার এটি শেষ করে প্রকাশ করা। তখনই শেষ লাইন দুটো লিখে ফেলি, ‘রংপুরের মাটিতে, কংক্রিটের ফুটপাতে/ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল নতুন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ,/আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ আবু সাঈদ।’
কবিতাটি শেষ করেই ফেসবুকে পোস্ট করি। ১৯ জুলাই পোস্ট করা এই কবিতাটিই এখনো পর্যন্ত আমার জানা মতে জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর রচিত প্রথম কবিতা। দু-চার দিনের মধ্যেই কবিতাটি আবৃত্তি করেন জিনাত জাহান, দিলারা নাহার বাবু, সবুজ হক, বম্বে থেকে তাপস মাইতি এবং আরো অনেকে। জিনাত একদিন আমাকে বলেন, ‘ভাইয়া বীরশ্রেষ্ঠ বলাটা কি ঠিক হয়েছে? এটার অনেক ভিউ এবং শেয়ার হচ্ছে, সমালোচনার মধ্যে পড়ব না তো?’ আমি ধারণা করি হয়তো এরই মধ্যে ওকে কেউ বকাটকা দিয়ে থাকবে। আমি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বলি, ‘ঠিকই আছে’।
এরপর ১৮ তারিখে উত্তরায় শহীদ হওয়া মীর মুগ্ধকে নিয়ে লিখি শতাধিক লাইনের এক দীর্ঘ কবিতা। শহীদ ইয়ামিনকে নিয়ে লিখেছি, নাম উল্লেখ না করে জুলাই অভ্যুত্থানের সার্বিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছি আরো ১০টি কবিতা, যার মধ্যে সাতটিই ৫ আগস্টের আগে রচিত।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh