সময়ই প্রমাণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সফল

২০২৪-এর জুলাই থেকে ধারাবাহিকভাবে কোটাবিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং যার ফলে শেখ হাসিনার পতন হলো তার শুরুটা মূলত ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন। এবার শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’-এর ব্যানারে সুসংগঠিত হয়ে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। যে দৃশ্য আঠারোর কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেখা যায়নি।

এবার আন্দোলনকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মীমাংসার কোনো পদক্ষেপ নেননি। ছাত্রদের দাবি ছিল অতি সামান্য। চিরকালীন আইনে পরিণত হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করতে হবে- এই ছিল তাদের দাবি। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন এবং তাদের সন্তানরা সরকারি চাকরিতে আবেদন এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকার পান, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আপত্তি ছিল না। অগ্রাধিকারের বিষয়টি নাতি-নাতনি পর্যন্ত চলে যাওয়া ছাত্ররা মানতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলে আওয়ামী লীগের, শেখ হাসিনার ও দেশবাসীরও ভালো হতো। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারতেন যে,  ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে, তবে এটা ৩০ থেকে ১০ শতাংশ করা হবে এবং এই কোটা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।’ এতে ছাত্ররা সম্পূর্ণ সম্মত হতো এবং এ আন্দোলনই হতো না। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত না নিয়ে শেখ হাসিনা দমন-পীড়নের পথে এগোলেন। আন্দোলনকারীদের ওপর আওয়ামী লীগের লোকজন, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী মরিয়াভাবে আক্রমণ করল। বহু মানুষ মারা গেলেন, পঙ্গু হলেন- এখনো হাসপাতালে বহুজন। আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করল, তখন আর্মি বুঝতে পারল তারা জনগণের মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা পিছু হটে যায়, শেখ হাসিনারও পতন ঘটে। 

সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সব সময়ই আমি বলে এসেছি, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের হাতে আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা যাওয়া উচিত নয়, রাজনীতিবিদদের হাতেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা যাওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। এ জন্যই রাজনীতির মান উন্নত করতে হবে আমাদের। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হলে রাজনীতির মানোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে এবং মানোন্নয়নের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। এই দায়িত্ব কোনো সরকারই নেয়নি। এরশাদ অনেক দিন ক্ষমতায় ছিলেন, প্রায় ৯ বছর। তার আগে এ দেশে কেউ এতদিন ক্ষমতায় ছিল না। এ বিষয়ে এরশাদের একটা জাতীয় মনষ্কতা ও জাতীয়তাবোধ ছিল, যে এই জাতির সন্তান আমি এবং জনগণের জন্যই রাষ্ট্র। মিলিটারি হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে এ বোধটি ছিল। এরশাদের মতো একজন স্বৈরাচারও বিরাজনীতিকরণ চাননি। তিনি চেয়েছিলেন কিছুকাল শাসন করে রাজনীতিবিদদের হাতেই দেশ ছেড়ে দিতে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের অনেকে নিজেরাই একের পর এক দূতাবাসে গিয়ে বিদেশিদের পরামর্শ নিয়ে, ওয়াশিংটনে গিয়ে তাদের সাহায্য প্রার্থনা করে রাজনীতিটাকে ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দিয়েছিল। 

কোনো বৈদেশিক শক্তি যেন আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের নীতির প্রয়োগ ঘটাতে না পারে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে এবং রাজনীতিবিদদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখতে হবে।  বর্তমানে দেশে ভারতবিরোধিতার যে জোয়ার বইছে- এই বিরোধিতা গঠনমূলকভাবে করতে হবে। ভারত বাংলাদেশের প্রায় চতুর্পাশ্বজুড়ে আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত আছে ২৫ মাইল আর বাকি সবই তো ভারতের সঙ্গে। এ অবস্থায় তো ভারতের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক রেখে চলতে হবে। অবশ্যই সে সুসম্পর্ক যেন সমমর্যাদাপূর্ণ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৭১ সালে ভারতের জনগণ, বামপন্থি দলগুলো ও ইন্দিরা গান্ধীর সরকার যেভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে, এ জন্য অবশ্যই আমাদের ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্মানজনক অবস্থানে থেকে আমাদের সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাইকারিভাবে ভারতের বিরোধিতা করা ভুল। যেমন- ভুল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে যাওয়া। সমগ্র মানবজাতির মধ্যে যেসব যুদ্ধবিগ্রহ ও ক্ষতিকর ঘটনা ঘটেছে, এর সবটায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা আছে। কোথাও যুদ্ধের আশঙ্কা দেখলে নানা কৌশলে উসকানি দিয়ে যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া তাদের নীতি। তারপর তারা অস্ত্র বিক্রি শুরু করে। অস্ত্রের ব্যবসাই বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যবসা। যুদ্ধটা হলো তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান অবলম্বন। আগে ছিল ব্রিটিশরা, পরে হলো আমেরিকানরা। 

এখন সময়ই প্রমাণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সফল হতে পারবে। তারা চাইছে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা উন্নতির দিকে যাক। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে খুব বেশি কিছু করাও সম্ভব নয়। তারা ভবিষ্যতের জন্য একটা অবস্থা তৈরি করে যেতে পারে। ভালো কিছু করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের চিন্তারও লিমিটেশন আছে। বিশ্বরাজনীতিতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর যে ভূমিকা, তার কেন্দ্রে আছে ওয়াশিংটন, সেই শক্তির ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য আপাতদৃষ্টে ভালো মনে হতে পারে-এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ  পরনির্ভশীলতা থেকে মুক্তি পাবে না। বরং পরনির্ভরতা আরো বাড়াবে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের যে আয়োজন করছে তা ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের জন্য। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যারা নির্বাচিত সরকার গঠন করবে, তারা যেন এ ধারায় চলে। এখন শুধু সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা। এরপর দেখার বিষয় নির্বাচিত সরকার এ পথে কতটা হাঁটবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh