আগামী নির্বাচনে ছাত্রদের নতুন দল কতটা ফ্যাক্টর হবে?

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং পরবর্তী সময়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস ধরেই আলোচনা চলছে। এ মাসের মধ্যেই নতুন দলের ঘোষণা আসতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানাবিধ আলোচনা যেমন আছে, তেমনি আছে সমালোচনাও। বিশেষ করে বিএনপির তরফে বলা হচ্ছে, ছাত্র ও সমন্বয়করা যদি সরকারের আনুকূল্যে কোনো দল গঠন করেন, তাহলে সেটি ‘কিংস পার্টি’ হবে এবং সেটি জনগণ মেনে নেবে না। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টারাও এই দলে যুক্ত হতে পারেন, এমন সম্ভাবনা থাকায় বিএনপি বলছে, দল গঠন করতে চাইলে তাদের সরকারি পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত।

ছাত্র ও সমন্বয়কদের এই দল গঠনের প্রক্রিয়ায় সরকারের যে সহযোগিতা রয়েছে, তা এখন ওপেন সিক্রেট। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ফিন্যানশিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘একটি সম্ভাবনা হলো, ছাত্ররা নিজেরাই একটি দল গঠন করবে। শুরুতে যখন তারা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করছে, তখন আমি তিনজন ছাত্রকে আমার উপদেষ্টা পরিষদে নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, যদি তারা দেশকে প্রাণ দিতে পারে, তাহলে তারা উপদেষ্টা পরিষদে বসতে পারে এবং প্রাণ দেওয়ার জন্য কী করছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’ ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন, ছাত্ররা রক্ত দিয়ে যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদের রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো সেই সব ব্যক্তি নিয়ে যাবে, যারা বিগত প্রশাসন ও অন্যদের মতো সবকিছুর পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ খুঁজছে। তার মানে ড. ইউনূস নিজেও চান ছাত্ররা একটি দল গঠন করুক।

রাজনৈতিক দলে যুক্ত হওয়া কিংবা নতুন দল গঠনের অধিকার সংবিধান সব নাগরিককেই দিয়েছে। কিন্তু সরকারি আনুকূল্যে কোনো দল গঠিত হলে জনমনে এবং রাজনৈতিক মহলে যে প্রশ্নটি উঠবে তা হলো, সরকারের আনুকূল্যে গড়ে ওঠা এই দল কি নির্বাচনেও বিশেষ সুবিধা পাবে?

অতীতে যেসব কারণে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বা পুরো ব্যবস্থাটি যে কারণে ধ্বংস হয়েছে তা হলো, নির্বাচনে একটি দলের পক্ষে রাষ্ট্রীয় সব আনুকূল্য। বাকি দলগুলোকে শুধু ক্ষমতাসীন দল নয়, বরং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকেও মোকাবেলা করতে হয়েছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনও সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আগামী নির্বাচনেও সেই একই ধারা বজায় থাকবে কি না, সেটিই মূল কনসার্ন।

যে জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের মতো একটি পরাক্রমশালী দলের পতন হলো এবং যে আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার মতো একজন শাসককে বিদায় নিতে হলো, সেই অভ্যুত্থানে যুক্ত ছাত্র ও তরুণরা যদি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং জনগণ যদি তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়, তা নিয়ে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে এটি নিয়ে বিতর্ক উঠবে বা এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, যদি দেখা যায় যে তারা দলটি গঠন করছেন সরকারি আনুকূল্যে, তথা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এবং দল গঠনের পরে ইসিতে নিবন্ধন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে এমনকি ভোটের সময়ও যদি সরকার তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে থাকে, তাহলে সেটি নতুন সংকটের জন্ম দেবে। তখন নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও অতীতের মতো দলীয়করণের অভিযোগ উঠবে।

অনেকেই এটা মনে করেন বা নানা ঘটনায় এটি এরই মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচন যতটা সম্ভব বিলম্বিত করতে চায়। তার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে। ১. জুলাই অভ্যুত্থান তথা আন্দোলন দমনের নামে যাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আছে, তাদের বিচার করা; ২. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং ৩. ছাত্রদের দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে যথেষ্ট সময় দেওয়া। তৃতীয় কারণটি সত্যি হলে সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারে বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠবে। যে ইঙ্গিত করে এরই মধ্যে বিএনপি মহাসচিবের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

বিএনপি ছাত্রদের এই দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে বেশি সমালোচনা করছে, তার কারণ সম্ভবত এই যে, বিএনপি মনে করছে যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। আর নির্বাচনটি যত বিলম্ব হবে, তাদের তৃণমূলে নানাবিধ স্বার্থের সংঘাত বাড়বে এবং তার ফলে তাদের জনপ্রিয়তা কমবে। অন্যদিকে এই সময়ক্ষেপণের মধ্যে ছাত্রদের গঠিত দলটি মাঠ পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম গোছাতে পারবে।

বিএনপির আরেকটি ভয় সম্ভবত তরুণ ভোটার। যেহেতু জুলাই অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনে ছিলেন এই তরুণরা এবং তাদের মধ্যে যাদের বয়স ১৭ বছরের বেশি, তারা সবাই ভোটার, অতএব এবারের নির্বাচনে তারা একটি বিরাট ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হবেন। সে কারণে নির্বাচনে তাদের একটি বড় সম্ভাবনা আছে। যদিও এককভাবে ছাত্রদের দল ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে নাকি তারা আরো কিছু দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় জোট গঠন করে অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, নির্বাচনের আগে যদি সেটি ঠিক না হয় এবং জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামিক দল, বিশেষ করে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশও যদি ছাত্রদের দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটি বিএনপির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কেননা বিএনপিকে তখন একই সঙ্গে তরুণ এবং ইসলামপন্থি দলগুলোর ভোটারদের মোকাবিলা করতে হবে।

আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে অংশ নিতে দেওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। কেননা এরই মধ্যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন। হয়তো নির্বাচনের আগে দলটির নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হবে। সেটি না হলেও দলের প্রধান শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাজা হয়ে যাবে, ফলে তারা নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। তখন দলে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেবে এবং মাঠ পর্যায়ে হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেওয়াটাও বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তখন নির্বাচনের মাঠে হয়তো একদিকে থাকবে বিএনপি এবং তাদের সমমনা কিছু ছোট দল, অন্যদিকে ছাত্রদের দল ও তাদের সম্ভাব্য জোটের দলগুলো।

তবে শেষমেশ কী হবে, তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি মিলে যে দলটি গঠন করবে, তারা যে আগামী নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে, সেটি আন্দাজ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে তারা যদি সত্যি সত্যিই সরকারি আনুকূল্যে দল গঠন করে এবং সরকার যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের সহায়তা করতে থাকে, তাহলে সেটি বিএনপির জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হবে। যে কারণে বিএনপি বারবারই দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আয়োজিত এক কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘সংস্কার প্রস্তাবের আলাপ-আলোচনা যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে, দেশ তত বেশি সংকটে পড়বে।’ নির্বাচন ছাড়া কোনো ভিন্ন পথ নেই উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘সংস্কারের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে সবার আগে নির্বাচনই প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু নির্বাচিত সরকার সমস্যার জট ধীরে ধীরে খোলার চেষ্টা করতে পারবে।’ তবে ছাত্রদের উচিত হবে, কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য না নিয়ে দল গঠন ও দলের কার্যক্রম পরিচালনা করা। তাহলেই বোঝা যাবে জনগণ আসলে তাদের সঙ্গে আছে কী নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh