অপারেশনের নাম ‘ডেভিল হান্ট’। মানে শয়তান শিকার। ফলে এটিকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ না বলে শুধু ‘ডেভিল হান্ট’ বললেও হতো। কেননা হান্ট বা শিকার মানেই একটা অভিযান।
যাই হোক, এই শয়তান শিকার বা বধ অভিযান শুরু হয়েছে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, প্রথম দিনেই গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এক হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মানে এক হাজার ৩০৮ শয়তানকে ধরা হয়েছে।
অভিযান শুরুর পরদিন রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যতদিন ‘ডেভিল’ থাকবে, অভিযান চলবে। তার মানে এই অভিযান কতদিন চলবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। প্রশ্ন হলো, এই ডেভিল বা শয়তান কারা? দেশে কী পরিমাণ ডেভিল আছে এবং তাদের সবাইকে ধরে ফেলতে বা হান্ট করতে কতদিন লাগবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, এই ডেভিল চিহ্নিত করার তরিকাটা কী? সরকার যাদের মনে করবে শুধু তারাই ডেভিল বা শয়তান?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যেদিন এই কথা বললেন, সেদিনই রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা জয়নুল আবেদিন ফারুক বলেছেন, ‘ডেভিল ধরার নামে টোকাই ধরলে জনগণ মানবে না। সরকারের ভেতরেও শয়তান আছে। তাদের ধরুন।’ তার মানে ডেভিলের সংজ্ঞা নিয়ে একটা ক্যাচাল ভবিষ্যতে লাগবে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে এই অভিযানে যদি বিএনপির নেতাকর্মীদেরও ধরা হয় তখন বিএনপি বলবে, এটি ডেভিল হান্ট নয়, বরং বিএনপি হান্ট কর্মসূচি। যেমন- ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে পরিচালিত অপারেশন ক্লিন হার্টকে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বলেছিল, এটি ‘আওয়ামী লীগ নির্মূল অভিযান’।
এবার অবশ্য এই হান্টের মূল টার্গেট যে আওয়ামী লীগ তাতে সন্দেহ নেই। কেননা অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্তির দিনে অভিযানটি শুরু হয়েছে। যদিও গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি, বিশেষ করে মব ভায়োলেন্সের নামে যেসব নৈরাজ্য হয়েছে; মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে। অনেকেই দাবি জানিয়েছিলেন, জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কিন্তু সেই পদক্ষেপটি নেওয়া হলো ছয় মাস পরে এসে এবং তাও গাজীপুরের বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
গাজীপুরে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারকে আলটিমেটাম দেন এবং সেদিনই অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। তার মানে এই অভিযানের প্রাথমিক স্পট গাজীপুর এবং ডেভিলের তালিকায় আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাই প্রধান।
অভিযান শুরুর পরদিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, ‘যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেখানে পরাজিত শক্তিকে কেউ রাখে না। আমরা অতটা অমানবিক হতে পারিনি। কেউ কেউ পালিয়ে গেছে, কেউ কেউ দেশে আছে। কিন্তু হঠাৎ করে অনেকেই অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে বা করবে, তাদের অপারেশন ডেভিল হান্টের আওতায় গ্রেপ্তার করা হবে।’ সরকার কি তাহলে ডেভিল হান্টের এই অপারেশন শুধু পরাজিত শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে টার্গেট করেই পরিচালনা করবে?
বস্তুত যেকোনো সরকারের আমলে পরিচালিত এই ধরনের অভিযানের মূল টার্গেট থাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্দলীয় হলেও তাদের প্রধান টার্গেট যে আওয়ামী লীগ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন তথা জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা, সে ক্ষেত্রে শুধু একটি গোষ্ঠীকে টার্গেট করলে লক্ষ্য পূরণ হবে না।
অপরাধ দমনের জন্য এই ধরনের অভিযান বরাবরই প্রশ্নের মুখে পড়ে, কারণ সরকার তথা অভিযান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষ থাকেন না বা থাকতে পারেন না। অন্তর্বর্তী সরকার দলনিরপেক্ষ হলেও তার কিছু স্টেকহোল্ডার বা অংশীজন আছে। সেসব অংশীজনের মধ্যে যদি ডেভিল থাকে, সরকার তাদের ধরবে বা ধরতে পারবে? অনেক সময়ই অপরাধ দমনের নামে পরিচালিত এসব অভিযান মানবাধিকার হরনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। গত দুই দশকে বিভিন্ন অপরাধ দমনে পরিচালিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, বিশেষ অভিযান এবং গোপন আটককেন্দ্র (আয়নাঘর) নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাহিনীগুলোর ভূমিকা অপরিসীম হলেও এর কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে জঙ্গি বা মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বিনা বিচারে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রকৃত অর্থে অনেক অপরাধী থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষও ভিকটিম হয়েছেন। তা ছাড়া একজন অপরাধীকেও যে বিনা বিচারে হত্যা করা যায় না, সেই নীতিটুকুও অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অনুসরণ করে না। আবার অনেক সময় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লোকজন অনেককে মেরে ফেলেছে, এই অভিযোগও ভূরি ভূরি। ফলে যখনই কোনো একটি বাহিনী বা যৌথ বাহিনী এ রকম অপরাধ দমনের নামে কোনো অভিযান শুরু করে, তখন জনমনে এই প্রশ্নটি প্রবল হয়ে দেখা দেয় যে সত্যিই কতজন অপরাধী ধরা পড়ল আর কতজন নিরীহ শিকার হলেন?
অতএব, ডেভিল হান্ট নামে যে অপারেশন চলছে সেখানে সরকার ও যৌথ বাহিনীর মূল চ্যালেঞ্জ হবে নিরপেক্ষ থাকা। ‘ডেভিল’ বলতে শুধু একটি দল বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের নির্মূল যদি এই অভিযানের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি এই সরকারের ভালো কাজকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি শান্তিতে নোবেলজয়ী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব এবং বৈশ্বিক মানবাধিকারের নীতিমালাগুলো অনেকের চেয়ে ভালো জানেন। অতএব তার সরকারের পরিচালিত ডেভিল হান্ট যেন সত্যিকারের ডেভিলদেরই হান্ট করে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। এর মধ্য দিয়ে অন্তত তিনটি লাভ হবে।
১. যারা সত্যিই দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তারা জুলাই অভ্যুত্থানে পরাজিত আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য যেকোনো দল বা সংগঠনের; এমনকি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংগঠনের নেতাকর্মীও যদি হয়, তার পরও তাদের আইনের আওতায় আনা গেলে সেটি সরকারের নিরপেক্ষতার বিষয়ে একটা সুস্পষ্ট বার্তা দেবে।
২. গত বছরের আগস্ট থেকে সাধারণ মানুষের মনে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ কাজ করছে, সেটি দূর হবে।
৩. একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো ভরসা পাবে। সরকারের ওপর তাদের আস্থা বাড়বে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh