কোন পথে বাংলাদেশ

ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বাধীনতা যেন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, বহু শক্তি ও অপশক্তি একই সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে পাঞ্জা লড়তে। অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা, সন্ত্রাস, চরমপন্থা, আতঙ্ক, হুমকি-ধমকি এ সময়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হওয়ার পর দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা বিকশিত হওয়ার বদলে যার যার শক্তিমত্তার পরীক্ষা চলছে যেন। দুর্বল আরো দুর্বল, সংখ্যালঘু আরো সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক আরো প্রান্তিক হচ্ছে। সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট বা শক্তিমানের টিকে থাকার এই পরিবেশ সহনশীলতা, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, বাকস্বাধীনতা, চলার স্বাধীনতা ইত্যাদিকে স্বীকার করতে নারাজ। কোনো একক সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তির স্বাধীনতাই যেন এখানে সব।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে এখন যেন হতবিহ্বল দেশ। বেশির ভাগ অভ্যুত্থানেই এমনটি হয়। অল্প কিছু অভ্যুত্থান বাদ দিলে বেশির ভাগই খুঁটিনাটি পরিকল্পনা বা মেটিকিউলাস ডিজাইন ছাড়াই হয়। বেশির ভাগই জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আকস্মিক বিস্ফোরণ। তাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিজয়ীদের মূল সমস্যা হয় তারা কী করবে তা নির্ধারণ। সবচেয়ে সহজ যে কাজটা তাতেই তারা মশগুল থাকে- এক. পরাজিত শত্রুশক্তিকে নিধন ও সমূলে উৎপাটন এবং দুই. যাকে নিধন ও সমূলে উৎপাটন করা প্রয়োজন মনে হয় তাকেই পরাজিত শক্তির সহযোগী ও দোসর হিসেবে ট্যাগ দেওয়া।    

কিন্তু অন্যান্য করণীয় আগের মতোই পড়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়, করণীয় কী তা বুঝতে না পারা। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, যাতে কোনো চরমপন্থি দল সমগ্র অভ্যুত্থানকে কুক্ষিগত করে ফেলার চেষ্টায় থাকে, আর মেটিকিউলাস ডিজাইন থাকলে তা সম্ভবও হতে পারে, যা কোনো দেশকে আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালের সফল অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশেও এসব সমস্যা ও প্রশ্ন প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান কতটা মেটিকিউলাস ডিজাইনের ফসল আর কতটা স্বতঃস্ফূর্ত সে বিতর্ক প্রাসঙ্গিক। যে বিপুল প্রাণের বিনিময়ে এই সফল অভ্যুত্থান তা কোনো নিখুঁত ডিজাইনের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে কোনো ক্রুড বা মোটাদাগের ডিজাইন থাকা স্বাভাবিক, আর তা গুরুত্বপূর্ণও। তাহলে নিখুঁত পরিকল্পনার বা মেটিকিউলাস ডিজাইনের কথাটা অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাজারে চালু হলো কী করে? এখানেই জয়ের সাফল্য কুক্ষিগত করার চেষ্টা নিহিত। নিখুঁত পরিকল্পনা যে বা যারা দেখাতে পারবে, জয়ের ফসল তাদেরই পকেটে ঢুকবে। মেটিকিউলাস ডিজাইনের বাইরে যারা তারা তখন কেবল দাবার ঘুঁটি হিসেবেই বিবেচিত হবেন, পরিবর্তনের নায়ক হিসেবে নয়। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে তেমনটাই দেখা যাচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের সব সাফল্য মেটিকিউলাস ডিজাইনওয়ালাদের পকেটেই ঢুকবে। এই লাভের হিসাব থেকে এটি স্পষ্ট যে, ৫ আগস্টের পূর্বেকার ডিজাইন ক্রুড হলেও পরবর্তী সময়ে তাই মেটিকিউলাসে পরিবর্তিত হয়েছে। আর এই ডিজাইনের অংশ হিসেবে অভ্যুত্থানের মঞ্চ থেকে একে একে অপসারিত হচ্ছে অংশগ্রহণকারী শ্রেণি, দল, গোষ্ঠী ও শক্তিগুলো। শেখ হাসিনার পতনের আগে সারা দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষই একাত্ম হয়ে গিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে, যা তার পতনকে অনিবার্য করে তোলে। এই আন্দোলন ধর্ম-বর্ণ-জাতি-পরিচয় নির্বিশেষে হয়ে উঠেছিল সবার- সবাই জড়ো হয়েছিল বৈষম্যবিরোধিতা নামের এক বৃহৎ ছাতার নিচে। কিছু ভাড়াটে গুণ্ডা ছাড়া তখন আর কেউ ছিল না স্বৈরাচারী শক্তির সঙ্গে।

কিন্তু বিজয় লাভের পরপরই দেখা যায় ছাতার নিচ থেকে একেকজনকে বের করে দেওয়ার নিখুঁত উদ্যোগ। প্রথম অসম্মান শুরু হয় দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেগম রোকেয়াকে দিয়ে। এরপর ধর্মীয় বিভাজন উসকে দেওয়ার পাঁয়তারা চলে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল পর্ব মুক্তিযুদ্ধকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সমান্তরালে দাঁড় করানোর চেষ্টা। চব্বিশের অভ্যুত্থান যেন তার পায়ের নিচের মাটিকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে, দাঁড়াতে চায় শূন্যের ওপরে। একাত্তরকে অস্বীকারের চেষ্টায় ষাটের দশকের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন ও বায়ান্ন পর্যন্ত অস্বীকারের চেষ্টা নিহিত। এই ইতিহাস-অজ্ঞানতা চব্বিশকেই খেলো করে তোলে। চব্বিশ তো শিকড়হীন হতে পারে না। বাঙালির জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত অর্জিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ফসলে চব্বিশের নতুন সংযোজন উল্লেখযোগ্য, আর তা যথার্থভাবে বিবেচনা করতে হবে। পূর্বেকার অর্জন ও ফসল ফেলে দেওয়ার চেষ্টায় কোনো অগ্রগতি ঘটবে না। 

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে জীবনানন্দ ও আল মাহমুদ হয়ে সাম্প্রতিক হেলাল হাফিজ পর্যন্ত আছে তিলে তিলে গড়ে তোলা সেই শস্যভান্ডার। হেলালের কথায় : “কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে/ সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ/ সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।”    

এই চেতনাই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত আমাদের সব সৃজনকর্মে। লালন থেকে রোকেয়া হয়ে মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল পর্যন্ত এই মৌল আকাঙ্ক্ষারই বহুমুখী প্রকাশ। অতীতকে, ইতিহাসকে ও আমাদের শ্রেষ্ঠ মনীষাকে অস্বীকার করবার যে গোঁয়ার্তুমি ইদানীং প্রকাশ হচ্ছে, তা যে দেশের ভবিষ্যতের জন্য মোটেও ইতিবাচক নয়, তা বলাই বাহুল্য। 

তো ইতিহাসের মোড়ে থমকে দাঁড়ানো বাংলাদেশ এখন কোন পথে যাবে? স্পষ্টতই যে পথ দুর্গম, কঠিন, বন্ধুর এবং রক্তে ও ঘামে নির্মিত- গণতন্ত্রের, পরমতসহিষ্ণুতার, ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক মৈত্রীর, বাকস্বাধীনতার, বিজ্ঞানমনস্কতার, শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার অধিকারের এবং সৃজনের আনন্দের। 

সৃজনের আনন্দই আধুনিক সমাজের বিকাশের মূলশক্তি। গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা ছাড়া নতুন কিছু সৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয়। আধুনিক ইউরোপ ও আমেরিকার জন্মই এই মৌল আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে। যদিও তা কখনো বাধাহীন ছিল না এবং এখনো নয়। ইসলামের গৌরবকালীন আমলের শক্তিও এসব আদর্শেই নিহিত ছিল। মধ্যযুগে যে সময় থেকে ইউরোপ এ আদর্শের পতাকা মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিল কিংবা মুসলমানরা ভুলক্রমে ছুড়ে ফেলল, পৃথিবীর ইতিহাস শেষবারের মতো ঘুরে গেল সে সময় থেকেই। 

বাংলাদেশেরও এখন সেই সময় যখন ঠিক করতে হবে আমরা উদার আদর্শবাদের ওই পরীক্ষিত পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরব, যেমন- ইতিহাসে আমাদের সংগ্রামী মনীষীরা ও নেতারা করেছেন, নাকি ছুড়ে ফেলব কোনো অপরিণামদর্শী অর্বাচীনের কিংবা পরিণামদর্শী সুচতুর কূটচালবাজের উসকানিতে। যেহেতু ফল আমাদেরই ভোগ করতে হবে, কর্মও ঠিক করতে হবে আমাদেরই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh