লকডাউনে ভালো নেই যৌনকর্মীরা

করোনায় গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন যৌনকর্মীরা। বাংলাদেশ উইমেনস হেলথ কোয়ালিশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ৭৪ হাজার ৩০০ নারী যৌন পেশায় আছেন। এদের ৫৪ শতাংশ যৌনপল্লীতে, ৪১ শতাংশ ভাসমান ও ৫ শতাংশ হোটেলে কাজ করেন।

‘আমাদের কেউ ভালো নেই। গত এক বছর ধরে খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। খদ্দের নেই, রোজগার বন্ধ। এত লকডাউন দিলে ক্যামনে আয় করমু। আমরা তো অন্য কোনো কাম জানি না। আজকে তিনদিন সন্ধ্যায় পানি আর বিস্কুট, মুড়ি ছাড়া কিছুই খাইনি। এভাবে রোজাও রাখতাছি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন যাত্রাবাড়ী ধলপুরে বসবাসরত মায়মুনা। 

শুধু মায়মুনা নয়, বাসাবোতে থাকেন সায়মা। তিনিও পেশায় যৌনকর্মী। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জানালেন, ‘করোনার কারণে এখন খদ্দের নেই। গত বছর লকডাউনের কারণে বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। গত কয়েক মাস আগে ঢাকায় আসছি। এখন আবার লকডাউন। রাতের বেলায় বাইরেও বের হতে পারি না। কাজ না করলে কেমনে চলুম। তিন মাস বাসা ভাড়া বাকি পড়ছে। আল্লায় জানে ঈদের আগে কপালে কী লেখা আছে?’ 

ময়মনসিংহ সদরের গাঙ্গিনারপাড় পতিতা পল্লীতে থাকেন মারুফা। তিনি জানান, ভালো নেই কেউ। এত খারাপ সময় আসবে কোনো দিনও ভাবিনি। রোজগার একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। জামানো যে টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার ছিল, তা বিক্রি করে দিয়ে প্রায় দুই মাস চলেছি; কিন্তু এখন তো আর দিন চলে না। কারও কাছে ধার চাইলেও দিতে চাচ্ছে না। এখন কীভাবে চলব, তিন ছেলে-মেয়ের ভরণ পোষণ কীভাবে করব? এটা ভেবে হতাশায় দিন কাটছে। 

এ দিকে মনি আক্তার নামে আরেক যৌনকর্মী বলেন, গত এক মাস ধরে কিছু কিছু খদ্দের পল্লীতে প্রবেশ করলেও, সেই সংখ্যাও আবার নগণ্য। আগে দিনে যেখানে প্রায় হাজারের ওপরে খদ্দের আসত, এখন আসে মাত্র দেড় থেকে দুইশ’ জন। করোনার ভয়ে তারা কেউ আর এই পল্লীতে আসার সাহস করছে না; কিন্তু লকডাউনের কারণে এখন আবার খদ্দের নেই। লকডাউনের মধ্যে বাড়িভাড়া মওকুফ থাকলেও, বাকি খরচগুলো করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আয় না থাকলেও ব্যয় ঠিকই হচ্ছে। এছাড়াও নিজের জন্য ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হচ্ছে। করোনা শুরুর দুই-তিন মাস জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন এবং বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহায়তা করলেও এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকার গুলশানে নার্গিস নামে এক যৌনকর্মী বলেন, সাত বছর ধরে এই পেশায় আছি। খাবার ও টাকার জন্য কোনো দিন কারও কাছে হাত পাততে হয়নি; কিন্তু মহামারি করোনার কারণে প্রায় এক বছর ধরে খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে। বাসা ভাড়া বকেয়া পড়ছে। ঈদের আগে দিতে পারব কি-না বুঝতাছি না। 

যৌনকর্মীদের সংগঠন শুকতারা কল্যাণ সমবায় সমিতির সম্পাদক রুমানা আক্তার রুমা জানান, ব্রিটিশ আমলে ময়মনসিংহ মহানগরীর কেন্দ্রবিন্দু গাঙ্গিনারপাড় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত পতিতা পল্লীতে বর্তমানে প্রায় ৩ শতাধিক কর্মক্ষম যৌনকর্মী আছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই সংক্রমণের ভয়ে স্থানীয় প্রশাসন পতিতা পল্লীর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এখানকার যৌনকর্মীরা নগদ অর্থ আয় করে দুই হাতে খরচ করে থাকে। বিশেষ করে অল্প বয়েসি ও নতুন পেশায় আসা যৌনকর্মীরা টাকা জমানোর কথা ভাবতেও পারে না। তাই অধিকাংশ যৌনকর্মীরা কাজ ও আয় রোজগার না থাকায় তারা অর্থাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

যৌনকর্মীদের সংগঠন শুকতারা কল্যাণ সমবায় সমিতির সভাপতি লাভলী হাসান বলেন, লকডাউনে কাস্টমার না থাকায় স্বচ্ছল অন্য যৌনকর্মীর বাসায় কাজ করে তাদের সহযোগিতায় চলতে হচ্ছে। আমি সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার দাবি করছি। সরকার একটু আর্থিক সহায়তার হাত বাড়ালেই একমাত্র তারা কিছুটা ডাল ভাত খেয়ে দিনযাপন করতে পারবে।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যৌনপল্লী হলো টাঙ্গাইল কান্দাপাড়া যৌনপল্লী। করোনার কারণে ভালো নেই কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর যৌনকর্মীরা। এখানকার ছয় শতাধিক যৌনকর্মী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। লকডাউনের শুরু ও লকডাউন পরবর্তী সময়ে দারুণ অর্থ কষ্টে খেয়ে, না খেয়ে দিন পার করছেন তারা। বাড়ি ভাড়া তো দূরের কথা ভাত জোগার করতেও হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। জেলা প্রশাসন থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সহযোগিতা চান এসব যৌনকর্মী।

এই যৌনপল্লীর যৌনকর্মী মৌসুমী আক্তার বলেন, দেড় বছরের মেয়ে নিয়ে প্রায় ৭ মাস ধরে খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে। টাকা না থাকায় মাইয়ার জন্য দুধও কিনতে পারি না। অন্যের বাড়ি থেকে ভাতের মার চেয়ে এনে মেয়েকে খাওয়াতে হচ্ছে। নিজেও মাঝে মাঝে দু-একদিন করে না খেয়ে থাকছি। 

শিখা আক্তার জানান, লকডাউনে কাস্টমার না থাকায় স্বচ্ছল অন্য যৌনকর্মীর বাসায় কাজ করে তাদের সহযোগিতায় চলতে হচ্ছে। আমি সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার দাবি করছি।

নারী মুক্তি সংঘের সভাপতি আকলিমা আক্তার লাখি বলেন, করোনাভাইরাসের শুরু থেকে এই পল্লীর সদস্যরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অন্যের সহযোগিতা নিয়ে চলতে হচ্ছে অনেককে। আবার কেউ কেউ বাসায় কাজ করে খুব কষ্টে দিন পার করছেন। অতি জরুরি ভিত্তিতে সহযোগিতা প্রয়োজন।

যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের সাবেক সভানেত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, সমাজে চাহিদা আছে বলেই আমরা আছি। এখন আমরা বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। সরকার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমরা সরকার থেকে ভালো প্রণোদনা চাই, যেন দু’বেলা খেতে পারি। আমাদের কষ্টের কথা কেউ জানতে চায় না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //