স্বপ্নের দেশ, স্কুলে নেই পরীক্ষা নেই কোন হোম ওয়ার্ক

যমরাজের মত ভয় পাওয়া পরীক্ষার মুখোমুখি হতে চান না অনেক শিক্ষার্থীই। কিন্তু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা- সব জায়গায় পরীক্ষা অর্জিত ফলাফলের বিচারেই শিক্ষার্থীর মান নির্ণয় করা হয়ে থাকে। প্রায়ই শিক্ষার্থীদের একটি আফসোস থাকে যে- ইশ! যদি ছাত্রজীবনে পরীক্ষা না থাকতো, কী দারুণ হতো তাহলে।

এমন শিক্ষার্থীদের জন্য স্বপ্নের গন্তব্য হতে পারে ফিনল্যান্ড। ইউরোপ মহাদেশের এই দেশটির কোনো স্কুলেই পরীক্ষা নামক আতঙ্কের বালাই নেই। ফলে গ্রেডের ওঠানামা নিয়েও ভাবনা থাকবে না। শুধু তাই না, এখানে বলতে গেলে আপনার জন্য থাকবে না বাড়ির কাজও।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ফিনল্যান্ডের স্কুলে কেন বাড়ির কাজ আর পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই? কারণ হলো, বিশ্বের অনেক দেশেই বাড়তি বাড়ির কাজের চাপ পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের বাজে ফলাফলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ফিনল্যান্ডে বাচ্চারা সপ্তাহে মাত্র ২০ ঘণ্টার জন্য স্কুলে যায়, সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিলে দৈনিক হিসেবে যা মাত্র ৪ ঘণ্টা। দৈনিক প্রতিটি ক্লাসের ফাঁকে বাচ্চারা ১৫ মিনিটের বিরতি পেয়ে থাকে। ফলে পরবর্তী ক্লাসে মনোযোগ স্থাপনের জন্য যেন তারা যথেষ্ট সময় পেয়ে থাকে।

প্রতিদিন ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোর ক্লাস শুরু হয় সকাল ৯টায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সময়ের পরেও ক্লাস শুরু হয়। বাচ্চাদের পর্যাপ্ত প্রাত্যহিক ঘুম এবং সারাদিনের কাজের প্রতি তাদের মনোযোগ নিশ্চিতেই স্কুল শুরুর এই সময়সূচি। এ প্রসঙ্গে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা লিনা লুইসভারা বলেন, “কোনো কিছু শেখার জন্য আপনার মস্তিষ্ক শান্ত থাকা জরুরি।”

অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, প্রতিদিন মাত্র ৪ ঘণ্টায় বাচ্চারা স্কুল থেকে কী শেখে? ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোর শিক্ষিকারা বইয়ের পাতা ধরে লেকচারের চেয়ে খেলার ছলেই বাচ্চাদের পাঠ্য বিষয়গুলো শিখিয়ে থাকেন। কারণ এভাবেই বাচ্চারা পাঠ্য বিষয়গুলো ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পারে।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, টিউশন ফি নিষিদ্ধ হওয়ায় ফিনল্যান্ডের স্কুলে ভর্তি হওয়া বাচ্চাদের বেতন বাবদ কোনো টাকা দিতে হয় না। এ কারণে সেই দেশে বেসরকারি স্কুলের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে ধনী-গরীব সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরাই একই ধরনের শিক্ষা পেয়ে থাকেন। এ কারণেই ফিনল্যান্ডে শিক্ষামন্ত্রী ক্রিস্টা কিউরু বলেন, “ফিনল্যান্ডের সব স্কুলের মানই একই রকম।”

শুধু পাঠ্যবস্তুর মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষাই না, স্কুলের কোনো ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য হওয়ার সুযোগ নেই। ফিনল্যান্ডে শিক্ষার প্রতি এতই গুরুত্ব আরোপ করা হয় যে এখানে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী হওয়ার চেয়ে শিক্ষক হওয়া তুলনামূলকভাবে কঠিন।

ফিনল্যান্ডের স্কুলে বাচ্চারা শুধু গণিতের সূত্র কিংবা ইংরেজি ব্যাকরণের নিয়ম নিয়েই পড়ে থাকে না। পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি এখানে রান্না করা, সঙ্গীতচর্চা, কাঠের কাজ শিখে থাকে। এমনকি কাব্যচর্চাকেও এখানে গুরুত্বের চোখে দেখা হয়। এমনকি এখানে বাচ্চারা দুপুরের খাবারও পেয়ে থাকে বিনামূল্যেই।

ফিনল্যান্ডে বাচ্চারা কখনোই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়তে বা প্রতিযোগিতা করে না। বরং পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে একত্রে শেখার প্রতি তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। ১৬ বছর বয়সের আগে কোনো শিক্ষার্থীকে ন্যাশনাল এক্সামেও বসা লাগে না। এমনকি সেই পরীক্ষাও ঐচ্ছিক।

ফিনল্যান্ডে স্কুলের এই নিয়মগুলো প্রভাব রেখেছে দেশটির স্বাক্ষরতার হারেও। ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যার ৯৯% মানুষই লিখতে এবং পড়তে সক্ষম। এমনকি গণিত এবং বিজ্ঞানেও এদেশের অনেকেই দারুণ দক্ষ। দেশের ৭০% শিক্ষার্থীই প্রতিদিন স্কুলে যেতে পেরে আনন্দিত।

সাধারণত পরীক্ষার ফলাফলে প্রাপ্ত গ্রেডকে শিক্ষার্থীদের ভালো-খারাপের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেক্ষেত্রে কারও ফলাফল আশানুরূপ না হলেই তাকে খারাপ ছাত্র হিসেবে গণ্য করা হয়, যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য বেশ হতাশাজনক। কিন্তু ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে এই ধারণা প্রযোজ্য না। এখানে বাচ্চাদের জন্য স্কুল কেবল গণিত বা ইংরেজী শেখার বিদ্যাপীঠই না, বরং জীবনে বেঁচে থাকার টনিক হিসেবে প্রশিক্ষণাগার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //