করোনাভাইরাস : মানসিক চাপে ভুগছে না তো আপনার সন্তান

করোনাভাইরাস মহামারির এই কঠিন সময়ে সবার মনের মধ্যেই নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। তাতে কাজের ক্ষতি হচ্ছে কখনো। আবার কখনো তার প্রভাব গিয়ে পড়ছে বাড়ির সদস্যদের উপরেও। তবে এই অস্বস্তি যে শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের হচ্ছে, এমন নয়। বাড়ির শিশুটিও এর মধ্যেই রয়েছে। প্রভাবিত হচ্ছে সেও।

শিশুরা অনলাইন ও টিভিতে যা দেখছে বা অন্যদের কাছ থেকে এই ভাইরাস সম্পর্কে যা শুনছে, তা বোঝা শিশুদের জন্য কঠিন হতে পারে। তাই তাদের মধ্যে উদ্বেগ, চাপ ও দুঃখবোধ তৈরি হতে পারে।

আবার গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানান মনোবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে শিশুদের মধ্যে।

করোনার কারণে গত বছরের ১৭ই মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বন্দি এ সময়ে শিশুরা মোবাইল ও ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মোবাইল বা টিভি নিয়ে হয় তারা ঘরের এককোণে পড়ে থাকছে। আর সেগুলো না পেলে ঘরের ভেতর এতটাই দুরন্তপনা করছে যে, তাদের শান্ত রাখতে অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে হাতে ডিভাইস তুলে দিচ্ছেন। 

আবার স্কুল একটি শিশুকে শুধু লেখাপড়াই শেখায় না, বরং তাকে সামাজিক হতেও শেখায়। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা বাড়ি থেকে বের হওয়ার বা অন্যদের সাথে মেশার সুযোগ একদমই পাচ্ছে না। দিন দিন অসামাজিক হয়ে উঠছে।


শুধু মানসিক সমস্যা নয়, দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুদের শারীরিক সমস্যাও বাড়ছে। শহুরে শিশুদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। দিনের পর দিন দীর্ঘসময় ইলেক্ট্রনিক ভিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাদের চোখ ও মস্তিষ্কের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে।

জীবনধারায় এমন সব পরিবর্তনের জেরে মানসিক চাপ বাড়ছে শিশুর উপর। আর শিশুরা নিজেদের মানসিক চাপের কথা সব সময়ে বলতে পারে না। তাই কয়েকটি দিকে বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। যাতে প্রয়োজনে তার যত্ন নেয়া যায় ঠিক উপায়ে।

খেয়াল রাখুন

১. শিশুর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে কি মাঝরাতে? এমন যদি চলতে থাকে নিয়মিত, তবে সতর্ক হওয়া দরকার। খারাপ স্বপ্ন দেখার কথা উল্লেখ করছে কি শিশু? না বললে নিজেই জিজ্ঞেস করুন।

২. আগের মতো নিয়ম করে খাওয়াদাওয়া করছে? নাকি মুখে অরুচি? খাবার পছন্দ না-ই হতে পারে। তবে খিদের অনুভূতি না থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

৩. রেগে যাচ্ছে কথায় কথায়? ভিতরে অন্য অস্বস্তি কাজ করলে এমন দেখা যায় বহু মানুষের মধ্যেই। শিশুদের ক্ষেত্রে তা খানিক বেশিই হয়। অস্বস্তির আসল কারণ প্রকাশ করতে না পেরে রেগে যায় তারা। টানা অনেকদিন এমন চললে এ নিয়ে কথা বলা জরুরি।


খেয়াল রাখবেন, শিশুদের মনের উপরে একইভাবে চাপ বাড়ছে। প্রাপ্তবয়স্করা হয়তো বা নিজেদের মানসিক চাপের কথা প্রকাশ করেন; শিশুরা তা করে না। তাই সে খেয়াল রাখতে হবে অভিভাবককেই।

শিশুদের স্বস্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। সেগুলো হলো:

১. খোলা মনে প্রশ্ন করুন ও শুনুন

করোনাভাইরাস নিয়ে সন্তানের সাথে আলোচনা করুন। বোঝার চেষ্টা করুন তারা বিষয়টি নিয়ে কতদূর জেনেছে এবং কি কি বিধিনিষেধ অনুসরণ করছে। 

নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করুন ও আপনার সন্তান যেন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে সেই সুযোগ তৈরি করে দিন। ছবি আঁকা, গল্প বলা বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তার সাথে আলোচনাটা শুরু করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলোকে কখনোই খাটো করে না দেখা বা এড়িয়ে যাওয়া। তাদের অনুভূতি-উপলব্ধিকে মেনে নিন এবং তাদেরকে বোঝান যে, এসব বিষয়ে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনার আচরণে এটা প্রকাশ করতে হবে যে, পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আপনি তার কথা শুনছেন এবং চাইলেই যেন আপনার ও তার শিক্ষকদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে সেই আত্মবিশ্বাস তাদের দিতে হবে।

২. সৎ হতে হবে

বিশ্বজুড়ে যা চলছে সে বিষয়ে জানার অধিকার শিশুদেরও রয়েছে। তবে বড়দেরও দায়িত্ব রয়েছে তাদের মানসিক যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখা। তাদের বয়স অনুযায়ী কথা বলুন, তারা কি প্রতিক্রিয়া দেখায় তা খেয়াল করুন, তাদের উদ্বেগের মাত্রা অনুধাবনের চেষ্টা করুন ও তাদের প্রতি সংবেদনশীল হন।


৩. মানসিকভাবে চাঙা রাখা

যখন আমরা টেলিভিশন বা অনলাইনে প্রচুর মন খারাপ করা ছবি দেখি তখন মনে হতে পারে যেন সংকট আমাদের চারপাশেই। শিশুরা এসব ছবি ও নিজেদের বাস্তবতাকে গুলিয়ে ফেলতে পারে এবং ভাবতে পারে তারা আসন্ন বিপদের মুখে। এসব ক্ষেত্রে সম্ভব হলে খেলাধুলা ও মনোবল চাঙা করার অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করে শিশুকে মানসিক চাপমুক্ত রাখা যায়। যতটা সম্ভব শিশুকে সময় দিতে হবে- বিশেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, আবার একটা নতুন পরিবেশে নতুন কিছু করতে গেলে তাকে সহযোগিতাও করতে হবে।

৪. অসুস্থ বোধ করলে

সন্তান অসুস্থ বোধ করলে বোঝাতে হবে যে, তার ঘরে থাকা বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিজের ও তাদের বন্ধুদের জন্য বেশি নিরাপদ। তাদের বোঝাতে হবে যে, এই সময়টা কঠিন (ভীতিকর, এমকি বিরক্তিকরও) হবে, কিন্তু এই নিয়মগুলো মেনে চললে সবাই নিরাপদ থাকবে।

৫. তারা স্টিগমার শিকার হয়েছে বা ছড়াচ্ছে কি না

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্ণ বৈষম্যের ঘটনা ঘটেছে বলে অনেক খবর প্রকাশ হয়েছে। তাই আপনার সন্তানও এ ধরনের বিদ্বেষের শিকার হচ্ছে কি না বা তা ছড়াতে ভূমিকা রাখছে কি না তা খতিয়ে দেখা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে যে, কোনো মানুষ দেখতে কেমন, সে কোথা থেকে এসেছে বা কোন ভাষায় কথা বলে, তার সাথে করোনার কোনো সম্পর্ক নেই। যদি তারা এ ধরনের আচরণের শিকার হয় তাহলে যেন সংকোচ না করে তাদের আস্থাভাজন বড় কাউকে বিষয়টি সম্পর্কে জানায়। সন্তানকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, স্কুলে নিরাপত্তা ও বন্ধুসুলভ আচরণ সবারই প্রাপ্য। কাউকে হেনস্তা করা কখনোই ঠিক নয়। বরং একে অপরের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বাড়াতে আমাদের সবারই দায়িত্ব রয়েছে।

৬. নিজের যত্ন নেয়া

এই পরিস্থিতির সাথে নিজে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারলেই আপনি সন্তানদের সহায়তা করতে পারবেন। এসব খবরে আপনার কি প্রতিক্রয়া ঘটে, তার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করবে আপনার সন্তান। তাই এই পরিস্থিতিতে আপনি সুস্থ ও শান্ত আছেন দেখলে তারাও স্বস্তি অনুভব করবে। আপনি উদ্বিগ্ন ও হতাশ বোধ করলে নিজের জন্য সময় দিতে হবে ও সমাজে আপনার আস্থাভাজন লোকজন, বন্ধু ও অন্যান্য পরিবারের কাছে গিয়ে কথা বলতে হবে। আপনি নিজে যাতে চাঙা ও উজ্জীবিত থাকেন সেজন্য কিছু সময় ব্যয় করতে হবে।


সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিশুদের মানসিক, সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশে মা-বাবাকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা বলেন, একদিকে তাদেরকে যেমন পাশে থাকতে হবে, অন্যদিকে শিশুরা যাতে পরিবারে থেকেই নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা হতাশ হয়ে গেলে মা-বাবাকে তার পাশে থাকতে হবে। পরিবারের বিকল্প কিন্তু কিছু নেই। আর এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পরিবারের উপরই এসে পড়বে। বাচ্চাদের পাশে, কিশোর-কিশোরীদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের বোঝানো, তাদের সময় দেয়া- পরিবারকেই করতে হবে।

তিনি মনে করেন, স্কুল বন্ধ থাকলেও শিশুদের নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত রাখতে হলে তাদের দৈনন্দিন কাজের একটি রুটিন করে দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে, ধর্মীয় প্রার্থনা, খাবার ও ঘুমানোর সময়, মা-বাবার সাথে বিভিন্ন কাজে অংশ নেয়া ও পড়াশুনার জন্যও একটা সময় বেঁধে দিতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //