শিশুকে জোর করে খাওয়ালে যে ক্ষতি হতে পারে

বহু বাড়িতেই এই সমস্যা রয়েছে। শিশুটি খেতে চায় না। মায়েরা চিন্তায় দিন কাটান। আর শিশুকে একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত মা বা বাড়ির বয়স্ক কোনও সদস্য তাদের খাবার খাইয়ে থাকেন। 

কিন্তু দেখা গেছে, অনেক সময় বাচ্চারা খেতে না-চাইলেও মায়েরা তাদের বকাবকি করে বা আদর করে জোরজবরদস্তি খাওয়াতে থাকেন। সন্তানকে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান রাখা এই জোরজবরদস্তির পিছনের উদ্দেশ্য হলেও, তা আদতে বাচ্চাদেরই ক্ষতি করছে। এ কথা অনেক অভিভাবকই বুঝে উঠতে পারেন না। 

অপরদিকে শিশু খেতে চায় না বা শিশুর অরুচির ধারণা সাধারণভাবে দুটো মূল বিষয়ের ওপরে নির্ভরশীল। একটি হলো- মা বা শিশুর পরিচর্যাকারী যেভাবে শিশুকে খাওয়াচ্ছেন তা তার প্রয়োজন, পছন্দ-অপছন্দ বা তার শারীরিক বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করা হচ্ছে না।

অথবা হয়তো শিশু উদরাময় বা অন্য কোনও অসুখে ভুগছে, যার কারণে তার খিদে লোপ পেয়েছে এবং তা শোধরানো হলে শিশু খেতে চাইবে।

এছাড়া কিছু খারাপ অভ্যাস শিশুদের খাবারের প্রতি অনাগ্রহী করে তোলে।

- শিশুকে যদি চামচে করে খাওয়ানো হয়, আর প্রায়ই তা জোর করে মুখে ঢোকানো হয়।

- খাবার শেষ করার পরও খাওয়ার জন্য অনুরোধ-আদেশ-নির্দেশ করা হয়।

- না খাওয়ার জন্য শাস্তি প্রদান করা হয়

- যখন-তখন যদি চাহিদামতো চিপস, জুস, চকলেট খেতে দিয়ে বায়না মেটানো হয়।

- প্রধান খাবারের মাঝখানে যখন-তখন স্ন্যাক্স খাওয়ানো হয়।

- খাওয়ানোর সময় নানাভাবে তার মনভোলানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যাতে সে অন্য কিছুতে মজে থাকার সময় বেশ তৎপরতার সঙ্গে কয়েক চামচ খাদ্য গেলানো যায়।

জোর করে খাবার খাওয়ানোর একাধিক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। কী কী ক্ষতি হতে পারে :

বমি করে দেওয়া

বাচ্চাদের জোর করে খাবার খাওয়ালে তারা তা ভালো করে না-চিবিয়ে গিলে খেতে শুরু করে। এই খাবার তাদের শরীরে কাজে লাগে না। ঠুসে ঠুসে খাওয়ায় তারা বমি করে দেয়।

হজমে সমস্যা

বাচ্চাদের জোর করে খাওয়ালে তাদের হজম সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে। খাবার গিলে খাওয়ায় তাদের পাচনতন্ত্রকে অধিক পরিশ্রম করতে হয়। এর ফলে পাচনতন্ত্র ভালোভাবে কাজ করতে পারে না।

ওজন বৃদ্ধির সমস্যা

জোর করে খাবার খাওয়ালে অতিরিক্ত খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা থেকেই যায়। জোর করে বেশি বেশি খাবার খাওয়ায় আহারের একটি বড় অংশ ফ্যাট হিসেবে শরীরে জমে যায়। যা ওজন বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে।

গলায় খাবার আটকে যাওয়া

ছোট বাচ্চাদের মুখে জোর করে খাবার ঠুসে দিলে তারা কাঁদতে শুরু করবে এবং খাবার তাদের গলায় আটকে যেতে পারে। এর ফলে সাময়িক কালের জন্য তাদের দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে এবং খাবার গিলতেও সমস্যা দেখা দেবে।

গিলে খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে

আগেই বলা হয়েছে, জোর করে খাবার খাওয়ালে বাচ্চারা তা চিবিয়ে না-খেয়ে গিলে ফেলে। প্রতিদিন এমন চলতে থাকলে বাচ্চারা চিবিয়ে খাবার খেতে শিখবে না। সব সময় খাবার গিলে খাবে।

গ্যাসের সমস্যা

ঠুসে খাবার খাওয়ানো হলে বাচ্চাদের মুখের পথ দিয়ে পেটে গ্যাস ভরে যেতে পারে। অন্য দিকে গিলে খাবার খেলে তা হজমে দেরি হবে এবং নানান সমস্যাও দেখা দিতে পারে, যার ফলে গ্যাস হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এই গ্যাসই কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ।

ওভার ইটিংয়ের অভ্যাস

যে বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই বেশি করে খাবার খায় তাদের ওভার ইটিংয়ের অভ্যাস গড়ে ওঠে। কত পরিমাণ খাবার খাওয়া উচিত, তা তারা বুঝতে পারে না। তাই বড় হলেও নিজে থেকেই বেশি বেশি খেতে শুরু করে।

স্বাদ বুঝতে অসুবিধা

জোর করে খাওয়ালে তাদের মধ্যে খাবারের প্রতি অনীহা গড়ে ওঠে। এর ফলে কোনও কিছু চেখে দেখার ইচ্ছা থাকবে না। এমনকি বাচ্চারা কোনও খাদ্য বস্তুর স্বাদ অনুভব করতে পারবে না।

শিশু খেতে না চাইলে কী করবেন

১. একই ধরনের খাবার শিশু প্রতি বেলা খেতে চায় না, তাই খাবার উপাদানে পরিবর্তন আনা উচিত।

২. প্রথম দিকে খাবারগুলো একটু চটকিয়ে দিন, পরে ঘন ও দানাদার খাবার পরিবেশন করতে হবে। এতে খাবারের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ তার স্বাদগ্রন্থিতে আবেদন সৃষ্টি করে।

৩. শিশুর ক্ষুধা লাগলেই তবে খেতে দিতে হবে। খিদে না পেলে জোর করে খাওয়ানো দরকার নেই। সময় দিয়ে, শিশুর পছন্দ–অপছন্দের তালিকা জেনে শিশুকে খাবার খাওয়াতে হয়।

৪. কখনও খেতে জোরাজুরি করতে নেই, বরং ধৈর্য ধরে খাওয়াতে হবে। শিশু যেসব পুষ্টিকর খাবার পছন্দ করছে, তাই খেতে দেওয়া ভালো।

৫. শিশু বয়সের পাকস্থলীর আকার ছোট, তাই এই ছোট পাকস্থলী যদি যখন-তখন পানি, জুস, চিপস, চকলেট দিয়ে ভর্তি থাকে, তবে সে আর অন্য খাবার খেতে পারবে না।

৬. প্রতিবার শিশু মুখে গ্রাস নেওয়ার সময় তার প্রশংসা করুন। তার চোখে চোখ রেখে উৎসাহ জোগান। পুরস্কারের দরকার নেই।

৭. শিশু যদি আন্ত্রিক অসুখে ভোগে, তবে তার খিদে কমে যায়। সেজন্য শিশুর খাবার পরিবেশন, খাবার তৈরি, খাবার সংরক্ষণ প্রতিটি পদক্ষেপে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বা হাইজিন বজায় রাখতে হবে। শিশুর খাবার তৈরি ও খাবার পরিবেশনের আগে সাবান–পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেওয়া জরুরি। কৃমি সংক্রমণ হলে তার চিকিৎসা করুন।

৮. শিশু যদি নিজে নিজেই খেতে চায়, তবে সেভাবে তাকে নিজের হাতে খাওয়ার জন্য সুযোগ দিতে হবে। প্রথম দিকে নষ্ট করবে, তবু নিজেকে খেতে দিন।

৯. খাওয়ানোর সময়ে শিশুকে টিভি দেখা, মোবাইলে কিছু দেখা বা খেলনা নিয়ে খেলতে দেওয়া উচিত নয়।

১০. বাচ্চারা রঙ, সাজসজ্জার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই বিভিন্ন রঙের শাকসবজি দিয়ে তৈরি পদ সুন্দরভাবে তাদের সামনে পরিবেশন করুন। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের খাবার ইচ্ছা বাড়বে।

১১. একবারে বেশি করে খাওয়ানোর পরিবর্তে অল্প অল্প করে বেশি বার খাবার খাওয়ান। এর ফলে খাবার খেতে খেতে একঘেয়ে লাগবে না এবং সহজে হজম করতে পারবে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //