শিশুর মিথ্যা বলার অভ্যাস বদলাতে

প্রায় সব শিশুই টুকটাক মিথ্যা কথা বলে। সঠিক সময়ে এটি রুখে না দিলে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। মনোবিদদের মতে, বকা বা শাস্তির ভয়ে মিথ্যা বলা দিয়েই এই অভ্যাস শুরু হয় শিশুদের স্বভাবে। অনেক সময়ে মা-বাবা এই স্বভাবকে অবহেলা করে গেলেও তা পরে বড় আকার ধারণ করে। ছোট থেকেই এই অভ্যাস পরিবর্তন না করলে তা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। 

আমেরিকান একাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি অনুসারে, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা একই কারণে মিথ্যা বলে- সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, ব্যক্তিগত লাভের জন্য, কাউকে প্রভাবিত করতে বা রক্ষা করতে বা ভদ্র সাজতে। অল্প বয়স থেকেই শিশুরা সত্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকে এবং তারা তাদের বিকাশের সব পর্যায়ে তা করতে থাকে। শিশুদের মিথ্যা কথা বলা খুবই সাধারণ। ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে নিজেদের বাড়িতে পর্যবেক্ষণ করা ৯৬ শতাংশ অল্পবয়সী শিশু কোনো না কোনো সময়ে মিথ্যা বলে। চার বছরের শিশুরা গড়ে প্রতি দুই ঘণ্টায় মিথ্যা বলে এবং ছয় বছরের শিশুরা গড়ে প্রতি ঘণ্টায় মিথ্যা বলে। 

কেন মিথ্যা বলে শিশুরা

  • শিশুদের কাছে ‘মিথ্যা বলা’ সঠিক না ভুল তা নির্ভর করে ওই ঘটনার ফল কী হবে তার উপর। যেমন- যদি শিশু জানে সে মিথ্যা বললে কোনো কিছু পাবে তাহলে তার কাছে মিথ্যা বলাই ঠিক মনে হয়। এ সময় অন্যকে মিথ্যা বলে মন রক্ষা করা শিশুর কাছে সঠিক কাজ মনে হয়।
  • শিশুরা বকা বা শাস্তির ভয়ে মিথ্যা বলে। যেমন স্কুলগামী শিশুদের হোমওয়ার্ক করা, খাবার খাওয়া, দুষ্টুমি করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার প্রবণতা বেশি থাকে।
  • মা-বাবা যথেষ্ট সময় না দিলে তারা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এজন্য শিশুরা অনেক মিথ্যা বাহানা তৈরি করে। এভাবে মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি হয়।
  • শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। অনেক সময় তারা মা-বাবাকে অনুকরণ করে মিথ্যা কথা বলা শেখে। যেমন- মা-বাবা সন্তানকে মুখে বলছে মিথ্যা বোলো না, আবার তার সামনেই অন্য কাউকে মিথ্যা বলছে। কথা ও কাজের ভিন্নতা দেখে শিশু সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারে না এবং মিথ্যা বলা শেখে।
  • বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গেছে, শিশুর মিথ্যা বলার সঙ্গে স্কুলের পরিবেশের সম্পর্ক আছে। যে সব স্কুলে বেশি শাস্তি দেওয়া হয় সেসব স্কুলের শিশুরা বেশি মিথ্যা বলে। 
  • কোনো কিছু পাওয়ার জন্যও শিশুরা মিথ্যা বলে। যেমন- শিশুকে বলা হলো শিশু রুটি খেলে তাকে আইসক্রিম দেওয়া হবে। তখন শিশু রুটি না খেয়ে জানাল রুটি খেয়েছে।

এই স্বভাবের জন্য অনেক মা-বাবাই শিশুদের ব্যাপক বকাবকি করেন। তবে শাসন বা মারধরে না গিয়েও এই স্বভাব রুখে দেওয়া যায়-

১. বড়রা কেউ মিথ্যা পছন্দ করে না অথবা মিথ্যা বিষয়টা গ্রহণীয় নয়- সে ধারণা ছোট থেকেই শিশুদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে। এজন্য রূপকথা, উপকথার এমন গল্পগুলো শিশুদের শোনাতে হবে, যেখান থেকে ওরা ভালো কিছু শিখতে পারে। আর মিথ্যা কথা মানুষের জন্য কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়টি বুঝিয়ে বলুন।

২. শিশুদের সামনে যতটা সম্ভব মিথ্যা এড়িয়ে চলুন। তারা অভিভাবকদের থেকেই সবচেয়ে বেশি শেখে। মিথ্যা বলা খারাপ বা বাড়ির সবাই মিথ্যা বলাকে কতটা ঘৃণা করে সে সম্পর্কে শিশুকে স্পষ্ট ধারণা দিন। 

৩. মিথ্যা কথা বললে বকাবকি না করে ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিন, দেখুন তাতে সমস্যা কমে কি না। পারিবারিক পরিবেশ শিশুর অনুকূলে এবং মা-বাবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে শিশু নিরাপদ বোধ করে এবং শিশুকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় না। মাত্রাতিরিক্ত আদর বা শাসন কোনোটাই শিশুর জন্য সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে বড়দের ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখাতে হবে। কঠোর হয়ে বা শাস্তি দিয়ে মিথ্যাকে রোধ করা যাবে না।

৪. সন্তান কোন বন্ধুর সঙ্গে মিশছে, সে দিকে লক্ষ রাখুন। বন্ধুদের মধ্যে কারও মিথ্যা বলার প্রবণতা থাকলে তা যেন শিশুকে প্রভাবিত করতে না পারে, সে বিষয়টিও নজরে রাখুন।

৫. কোনটা মিথ্যা আর কল্পনা, তা বুঝতে হবে। কল্পনাজনিত মিথ্যার অভ্যাস বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যায়। তবু খুব ছোটবেলা থেকেই শিশুকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সত্য বলার শিক্ষা দিতে হবে। তাই শিশুকে কল্পনা আর মিথ্যার তফাতটা ধরিয়ে দিতে হবে।

৬. কোনোভাবেই শিশুর মিথ্যা রুখতে না পারলে মনোবিদের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //