ইভিএম বিতর্কে সিটি নির্বাচন

আসন্ন ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ নির্বাচনে অংশ নেয়া অন্য প্রার্থীদের মধ্যে চলছে তুমুল বিতর্ক। 

একই সঙ্গে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ নিয়ে ভোটারদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ ও শঙ্কা। 

তবে এই বিতর্ক ও সন্দেহের মুখেই ইভিএমে ভোটের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইভিএমে কারচুপির সুযোগ একেবারেই নেই, তা নয়। তবে প্রচলিত অনিয়ম, কারচুপির সুযোগ কম। ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন মহলে যে সংশয়, তা ইসিকেই দূর করতে হবে।

ইসি বলছে, এবার কঠোর হবে ইসি। কেন্দ্র দখল হলে বন্ধ হবে ভোট। ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন করতেই ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে অনিয়ম ও কারচুপি কমবে। 

এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএমের পক্ষে। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ইভিএমের বিপক্ষে। বিএনপির আশঙ্কা, ইভিএমে ডিজিটাল কারচুপি হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুটি জায়গায় ইভিএমে ভোট কারচুপির সম্ভবনা রয়েছে। প্রথমত, ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙুলের ছাপে ভোট দেয়ার সুযোগ দিতে পারেন। এভাবে ২৫ শতাংশ ভোটারকে কর্মকর্তা সুযোগ দিতে পারেন। এখানে কারচুপি হতে পারে। তবে ইসি বলছে, এবার সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার এই ক্ষমতা কমিয়ে ৫ শতাংশের মধ্যে আনা হবে। 

দ্বিতীয় শঙ্কা হলো, ইভিএমে বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফল পরিবর্তন সম্ভব। কারণ ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। অর্থাৎ যন্ত্রে ভোট দেয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রিন্ট কপি ব্যালট জমা হওয়ার সুযোগ নেই। তাই কারচুপি হলে তা প্রমাণ করা যাবে না। তবে ইসি বলছে, এ ধরনের সন্দেহ থাকলে যে কেউ বিশেষজ্ঞ এনে ইভিএম পরীক্ষা করতে পারে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সামনে এই সিটি নির্বাচন নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইভিএমের কার্যকারিতা কতটুকু, ভোটার এটি ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারবেন কি না এবং ভোটে নিরাপত্তা দেয়া হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে মক ভোটের মাধ্যমে ভোটারদের এর কার্যকারিতা ও ব্যবহার পদ্ধতি দেখাতে কিছু কিছু জায়গায় ইভিএম রেখেছে। তবে এর মাধ্যমে ৫০ লাখ ভোটারকে সম্যক ধারণা দেয়া সম্ভব নয়।’ 

তিনি বলেন, ‘ইভিএম যদিও নিখুঁত পদ্ধতি, তবে জনগণের মনের শঙ্কা দূর করতে ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। টেলিভিশনে ইভিএম সম্বন্ধে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে ধারণা দেয়া উচিত। এছাড়া নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দলের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সংশয় দূর করতে পারে। এটা করা না হলে গোটা রাজধানীতে ব্যবহার না করে কিছু নির্বাচিত ওয়ার্ডে তা ব্যবহার করার চিন্তা করা যেতে পারে। তবে এতে প্রকৃত ভোটার ছাড়া ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। রাতে ভোট দেয়ার সুযোগ নেই।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা জানিয়েছেন, এর আগে বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে সুফল পাওয়ার কারণেই নির্বাচন কমিশন ইভিএম ধরে রেখেছে। প্রথমবারের মতো পুরো ঢাকা মহানগরে একসঙ্গে ইভিএমে ভোট করতে তারা পুরোপুরি প্রস্তুত।

জানা যায়, ইভিএম পরিচালনার জন্য এবার প্রতি কেন্দ্রে দুইজন করে সেনাসদস্য রাখারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। তবে তারা শুধু ‘টেকনিক্যাল সাপোর্ট’ দেবেন। দুই সিটিতে দুই হাজার চারশ’র বেশি কেন্দ্র রয়েছে। আর ১৪ হাজার ছয়শ’র মতো ভোটকক্ষ থাকছে। তাই সব মিলিয়ে রিজার্ভসহ ৩০ হাজার ইভিএম রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতি কেন্দ্রে ব্যাকআপ হিসেবে একটি করে ইভিএম রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসারদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ইসি ও ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করবে যারা, তাদের ওপরই মানুষের আস্থা নেই। ইভিএমে কারসাজি করা সহজ। ইভিএমে এমন সফটওয়্যার ঢোকানো সম্ভব, যাতে এক মার্কায় ভোট দিলে তা অন্য দিকে যাবে। এছাড়া আঙুলের ছাপ না মিললেও ২৫ শতাংশ ভোটারকে ভোট দেয়ার সুযোগ দিতে পারেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।’ 

তিনি বলেন, ‘ভোটারদের বেশিরভাগ এখন পর্যন্ত ইভিএমের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত নন।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রার্থী ডা. সাজেদুল হক রুবেল বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে শঙ্কা আছে। ইভিএম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ভারতেও এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এছাড়া ভোটারদের প্রশিক্ষণের বিষয় আছে। এত অল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক ভোটার, নির্বাচনের কর্মকর্তাদের কীভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে?’

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘ঢাকা সিটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিষোদগার করছে। তবে সন্দেহ থাকলে তারা ইসিতে গিয়ে ইভিএম পরীক্ষা করে দেখতে পারে। ভোট গ্রহণের আগে এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করতে পারে। কোনো ত্রুটি পেলে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করতে পারে। কিন্তু তা না করে ঢালাও অভিযোগ করে যাচ্ছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। কারণ তারা জানে, তাদের জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।’

ইভিএমের প্রচলন শুরু করেছিল শামসুল হুদা কমিশন। ২০১২ সালে প্রথম কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোট পুরোপুরি ইভিএমে হয়েছিল। এরপর রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণে ত্রুটি দেখা দেয়ায় রকিব কমিশনের শেষ সময়ে বেশকিছু দিন বন্ধ ছিল এই পদ্ধতি। 

বর্তমান কমিশনের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার দুটিসহ মোট ছয়টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮০ শতাংশ। তবে ইভিএমের ছয়টি আসনে ভোটের হার ছিল গড়ে ৫১.৪১ শতাংশ। এর আগে-পরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে আংশিকভাবে ইভিএম ব্যবহৃত হয়। পৌরসভা নির্বাচনে বেশিরভাগ সদর পৌরসভায় ভোট নেয়া হয় ইভিএমে। রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচন হয়েছিল ইভিএমে। 

এবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড সংখ্যা ১৮টি। মোট ভোটার ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন। আর সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র এক হাজার ৩৪৯টি, ভোটকক্ষ সাত হাজার ৫১৬টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ২৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। এক হাজার ১২৪টি ভোটকেন্দ্রের পাঁচ হাজার ৯৯৮টি ভোটকক্ষে এবার ভোটগ্রহণ হবে। মোট ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৮ জন ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //