সংসদ কি শুধুই ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ বলার জায়গা

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘অনেকেই বলেন- বাজেট হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই। এখানে যেন কোনো অপচয় না হয়। কিন্তু আমরা যে আলোচনা বা বিতর্ক করব, সেই বেসিসটা (ভিত্তি) তো ঠিক থাকতে হবে। আমরা সংসদে আছি শুধু হ্যাঁ বা না বলার জন্য।’

গতকাল শনিবার (১২ জুন) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট সংলাপে সাবের হোসেন এসব কথা বলেন।

সংসদ সদস্য সাবের হোসেনের বক্তব্যে যে আক্ষেপের সুর, তার আলাপ কিংবা বিস্তার অনেক বড়। তিনি একা নন, সাম্প্রতিক সময়ে এমন হতাশার কথা শোনা যাচ্ছে অনেক সংসদ সদস্যের মুখেই। কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, সংসদ সদস্য হিসেবে আইন প্রণয়নই আমাদের প্রধান কাজ। তবে, বাস্তবতা হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পালন করতে পারি না। এক্ষেত্রে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের তো আরও সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের সংসদীয় ক্ষমতা আরও বাড়ানো দরকার। সংসদকে আরও কার্যকর করা দরকার।

কিন্তু কেন এমন হল? সংসদ সদস্যরা কেন সংসদে তাদের ভূমিকা রাখতে পারছেন না?  

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ১১টি জাতীয় সংসদ পেয়েছে। এর মধ্যে সামরিক-আধা সামরিক সরকারের আমলে যেসব সংসদ গঠিত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তেমনভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনামলে গঠিত সংসদগুলোর কার্যকারিতা আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। দেশে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয় নব্বইয়ে সামরিক শাসক এরশাদের বিদায়ের পর।

কিন্তু পরবর্তী কোনো সংসদে সরকারি ও বিরোধী দল পুরো মেয়াদে একসঙ্গে কাজ করেছে, এ রকম উদাহরণ নেই। বিশেষ করে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো এবং বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলো সংসদ বর্জনকে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ একমাত্র উপায় হিসেবে নিয়েছিল। আর সেই সুযোগে সরকার নিজের ইচ্ছেমতো সংসদ পরিচালনা করেছে, আইন তৈরি করেছে। নবম সংসদ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।

দশম সংসদে এসে দেশের মানুষ নতুন অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। ওই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রতিবাদে। ফলে ভাগ্য খোলে জাতীয় পার্টির। দলটি নির্বাচন নিয়ে অভিনব নাটক মঞ্চস্থ করে এবং দশম সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে। একই সঙ্গে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার হয়। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ওই সংসদে প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরোধী দল ছিল না। মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করেছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল শুধু সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয় না, নিজেরাও বিকল্প বা ছায়া সরকারের দায়িত্ব পালন করে। ব্রিটেনে বিরোধী দল সরকারের প্রতিটি দফতরের জন্য একজন ছায়া মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের কোনো নীতি পছন্দ না হলে তারা শুধু সমালোচনা করে দায়িত্ব শেষ করেন না, বিকল্প প্রস্তাবও উত্থাপন করেন। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কিছু সময়ের জন্য ধারাটা শুরুও করেছিল। এরপর ‘তত্ত্বাবধায়কের বিতর্ক’ সবকিছু তছনছ করে দেয়। দুই পক্ষের মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

দশম সংসদ নির্বাচনের পর কেউ মনে করেন না ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তারা নির্বাচনে এলে নাকি সমানে সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসার পরও কেন সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না? কেন বিএনপির আসনসংখ্যা দশকের ঘরে পৌঁছাল না (৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি জোট পেয়েছে মাত্র ৭টি) সেই প্রশ্নের জবাব নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনের সংস্কৃতি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা রদবদলের সম্ভাবনা দূরীভূত হয়েছে। তারই প্রভাব দেখা যাচ্ছে সংসদের মধ্যে।

সরকারের কার্যক্রম জবাবদিহির মধ্যে আনার একটি প্রক্রিয়া হলো মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটি। সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করেছে এ রকম দৃষ্টান্ত বিরল। নবম সংসদ পর্যন্ত বিরোধী দল অধিবেশন বর্জন করলেও সংসদীয় কমিটির বৈঠকগুলো হতো। দশম সংসদে সেটিও হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং শুদ্ধাচার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটিগুলোর যে অপরিহার্য ভূমিকা, তা কার্যকর হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই।

সংসদ সদস্যের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু সেই আইনের বিষয়ে কতজন সংসদ সদস্য আগ্রহী বা ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন, সে প্রশ্ন অনেকের মনেই। নব্বইয়ের দশকে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার প্রথম যখন সরাসরি সংসদের ধারা বিবরণী প্রচার করত, তখন মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ত। এখন তারা ফিরেও তাকায় না।

একাদশ জাতীয় সংসদের (২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) পাঁচটি অধিবেশন নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদন ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, বর্তমান সংসদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে বলেছে, জাতীয় সংসদ তার মৌলিক দায়িত্ব আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর নেই। বেশিরভাগ সংসদীয় কমিটির পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে।

জনগণের প্রতিনিধি হয়ে জনগণের অর্থের অপচয় যারা করেছেন, তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনার উপায় কী? সংসদের হুইপরা সংসদ সদস্যদের উপস্থিতির বিষয়ে সজাগ করে থাকেন। কিন্তু যে সংসদে গড়ে ৩১ মিনিটে বিল পাস হয়, সেই সংসদে কথা বলার সুযোগ থাকে না। হাত তুলে হ্যাঁ জয়যুক্ত করা ছাড়া কারও কোনো কাজ থাকে না। এ রকম সংসদ আর দলীয় সভার মধ্যে ফারাক করা কঠিন। তদুপরি সব সময় ৭০ ধারা মাথার ওপর ঝুলছে। দলের বাইরে কিছু বললেই বিপদ। ‘চাকরি থাকবে না’। 

অষ্টম ও নবম সংসদে অধিবেশন বর্জনের অগ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি চালু ছিল। তা বন্ধ হয়েছে অনেক চড়া দামে। এত বেশি চড়া দামে যে মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো হয়েছে। 

সংসদে এখন একদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে একচ্ছত্র ক্ষমতার সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে সংসদের মৌলিক দায়িত্ব আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহিতা এবং জনপ্রতিনিধিত্ব এই তিনটি ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। এমনকি সম্ভাবনাও ক্রমাগত বিলুপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //