চট্টগ্রাম-কক্সবাজারকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণার উদ্যোগ

দেশে মাদক প্রবেশের সবচেয়ে বড় রুট চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অভিযান জোরদারের লক্ষ্যে জেলা দুটোকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণার রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু করেছে।

আজ রবিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গত ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কমিটির আগের বৈঠকে মাদক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে মাদক পাচারে জড়িত রোহিঙ্গাদের বিচারে পৃথক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব আসে।

সভায় সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় করে চট্টগ্রাম মেট্রোপিলিটন এলাকা এবং কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করার বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। 

কমিটি বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, আগের বৈঠকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ্ আল মাসুদ চৌধুরী জানান, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও উৎপাদনকারী দেশগুলোর কাছাকাছি অবস্থান, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকে আক্রান্ত। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ, ভারত থেকে হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইনজেক্টিক ড্রাগের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে। তিনি সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক চোরাচালান রোধে সীমান্ত পাহারা জোরদার, স্যাটেলাইট মনিটরিং প্রযুক্তি স্থাপন এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন, চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার এলাকাকে মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণা করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেন।

ওই বৈঠকে ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যা করছে, তা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে করছে। এরা রাতে ওপারে গিয়ে সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাদকপাচার করছে। যে মাদক উদ্ধারের কথা জানা যায়, তা মূলত দুই বা তিন শতাংশ মাত্র। এতে সহজেই অনুমান করা যায়, কী বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সেখানে সম্পৃক্ত। এ এলাকাটি এখন মাদকের অভয়ারণ্য। সেখানে মসজিদের ইমামও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। এই এলাকায় দিনের বেলায় এক চিত্র, রাতে তা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এ অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় লোকও সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই বিষয়টি কঠোরভাবে দমন করা জরুরি।

কোনাপাড়া ক্যাম্প ও নো ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের চলাচল এবং যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি উল্লেখ করে মেজর জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, রোহিঙ্গারা আলাদা জনগোষ্ঠী এবং তাদের সংস্কৃতি আলাদা। এরা এ দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী। তাদের অপরাধের বিচার এ দেশের প্রচলিত আইনে না করে, তাদের জন্য আলাদা আইনি ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে অপরাধ করে বের হয়ে যেতে না পারে। মাদকের বিচারকাজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে উদাহরণ সৃষ্টি করা দরকার। যাতে সবাই ভয় পায় এবং বুঝতে পারে, বেআইনি কাজ করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা বিদ্যমান।

ওই বৈঠকে বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।

তিনি বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ডাটাবেইস তৈরি করা হয়। রোহিঙ্গা ডাটাবেইসটি এনটিএমসিকে প্রদান করা হলেও ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ে তা হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে বর্তমানের ডাটাবেইস না থাকায় আইন প্রয়োগকারী, গোয়েন্দা ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো বিভিন্ন তদন্তের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। এতে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণার পুনরুল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, মাদকের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি যে-ই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। মাদক ব্যবসায়ী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রীর থেকে তা শক্তিশালী নয়। ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের সঙ্গে কোনো আপস হতে পারে না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এখানে বাস করতে হলে আমাদের দেশের আইন মানতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়, এমন কর্মকাণ্ড থেকে তাদের দূরে থাকতে হবে। এসব বন্ধ না করলে হয় তারা তাদের দেশে ফেরত যাবে, না হয় অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

বৈঠকে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্য পীর ফজলুর রহমান বৈঠকে বলেন, মাদক পাচারের বিভিন্ন রুটের মধ্যে কক্সবাজার রুটেই বেশির ভাগ মাদক প্রবেশের কথা জানা যায়। বর্তমানে মাদক পাচার কমে যাওয়ার পরিবর্তে এখন প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কক্সবাজার এলাকায় মাদক পাচার রোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বিশেষ ভাতার আওতায় আনার প্রস্তাব করেন তিনি।

বৈঠকে কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমদ জিরো পয়েন্টে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মাদক পাচারের বড় রুট হিসেবে এ পয়েন্টটি চিহ্নিত হয়ে আছে।

সর্বশেষ বৈঠকে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে ও মানবিক সেবায় নিয়োজিত সকল স্তরের পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, ফায়ারসার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ঝুঁকি ভাতা প্রদানের সুপারিশ করা হয়।

কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমেদের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সামছুল আলম দুদু, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পীর ফজলুর রহমান, নূর মোহাম্মদ ও রুমানা আলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //