প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় রেশমের চাষাবাদ থেকে কাপড় বোনা হতো। ধারণা করা হয়, ১৭৮৬ সালে কিংবা তারও আগে রাজশাহী ও আশেপাশের অঞ্চল রেশম চাষের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রেশমের সুতা তৈরিতে রাজশাহীর বোয়ালিয়ার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বোয়ালিয়ায় তখন বিস্তৃত এলাকাজুড়ে তুঁত চাষ করা হতো।
রাজশাহীর বিসিক শিল্প এলাকাকে বলা যায় সিল্কের এলাকা। এখানে সপুরা সিল্ক ছাড়াও হাঁটা দূরত্বে আছে ঊষা সিল্ক, আমেনা সিল্ক, রাজশাহী সিল্কসহ বেশকিছু শো-রুম। পুরোপুরি সিল্ক ছাড়াও রেশম সুতার সঙ্গে বিভিন্ন কাপড়ের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সেমি-সিল্ক পোশাক বিক্রি হয়।
রাজশাহীতে কয়েক বছর আগেও ৬০ থেকে ৭০টি সিল্ক কারখানা ছিল। বর্তমানে চালু আছে মাত্র তিন-চারটি। রেশমের সংকটে সুতা আমদানিতে অধিক হারে শুল্ক থাকায় কাপড়ের দাম বেড়েছে। লোকসানের কারণে ২০০২ সালে বন্ধ করে দেওয়া রাজশাহী রেশম কারখানা ২০১৮ সালে পুনরায় সচল হয়েছে।
এখন উৎপাদিত সুতা দিয়ে চাহিদার ২০ শতাংশও পূরণ করা যায় না। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সুতার ওপর ভর করে এখন রাজশাহীর রেশম শিল্প চলছে। তাছাড়া রেশম সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা সীমিত হয়ে গেছে।
রাজশাহী সিল্কের মূল উপাদান রেশম হলো এক ধরনের সূক্ষ্ম ও কোমল সুতা। এটি দিয়েই তৈরি হয় মসৃণ সিল্ক। তুঁত গাছের সবুজ পাতায় পলু পোকার গুঁটি রেখে প্রক্রিয়াজাত করে সুতা আহরণ হয়। তুঁত চাষ ও পলুপালনকে একত্রে রেশম চাষ পদ্ধতি ধরা হয়।
বাংলাদেশের আবহাওয়া রেশম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। ফলে তুঁত গাছ ৩০-৩৫ পর্যন্ত বছর বাঁচে। রেশম পোকা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে। তাই রেশম নিয়ে প্রচলিত একটি প্রবাদ হলো, ‘উদ্ভিদের পাতা খেয়ে পোকা, ঢেলে দেয় সোনার টাকা’।
রেশম পোকা পালনকে রাজশাহীর স্থানীয় ভাষায় পলুপালন বলা হয়। রেশম পোকার প্রাণ চারটি পর্যায়ে বিভক্ত। এগুলো হলো ডিম, শূককীট, মূককীট ও পূর্ণাঙ্গ পোকা। পূর্ণাঙ্গ দশার পোকাকে সাধারণত মথ বলা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির মথ বিভিন্ন মানের রেশম সুতা তৈরি করে। রেশম গুটি বছরে কমপক্ষে চার-পাঁচবার উৎপাদন করা যায়। মার্চ মাসের শেষে, জুন মাসের প্রথমে, আগষ্ট মাসের শেষে এবং নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি রেশম গুটি উৎপাদিত হয়।
সুতা পেতে রেশম শ্রমিকরা আধা ঘণ্টা গরম পানিতে গুটি সিদ্ধ করেন। আট-দশটি গুটির মাথা একত্র করে মেশিনে দিলে একটি সুতা বের হয়। একেকটি গুটি থেকে অন্তত ৫০০ মিটার সুতা পাওয়া যায়। সুতা তৈরির কাজ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে করে থাকেন নারী-পুরুষ শ্রমিক।
কারখানায় রেশম সুতা পরিষ্কার ও রঙ করে থাকেন শ্রমিকরা। কেউবা ব্যস্ত থাকেন ছাপার কাজে। কাঁচা সিল্কের শাড়ি কিনে নিয়ে নকশা এঁকে বাড়তি আয় হয় কারও। কেউবা কাপড় কিনে নিয়ে ঘরে বসে অনলাইনে বিক্রি করেন।
সিল্কের পণ্য কিনতে বিভিন্ন জেলার ক্রেতাদের দেখা যায় রাজশাহীতে। বাহারি রঙ ও আকর্ষণীয় কারুকাজে সাজানো সিল্কের শাড়ি সাড়ে ৩ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সিল্কের তৈরি থ্রি-পিসের দাম ২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। হাতের কাজ করা একেকটি পাঞ্জাবি সাড়ে ৫ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা।
রাজশাহী সিল্কের সুনাম ছাড়িয়েছে দেশের সীমানা। বিশ্ববাজারে রেশমের চাহিদা অপরিসীম। ২০২১ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্য তথা নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্ক। বিশ্ব মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিআরও) এই সম্মান দিয়েছে।