দেশ ভাগের কবিতা

নন্দর মা!

সেই কোন দেশে আমরা যাচ্ছিলাম
কোন দেশ ছেড়ে আমরা যাচ্ছিলাম
পেরিয়ে পেরিয়ে উঁচু, নিচু, ঢালু মাঠ
শিশির ভেজানো কাঁটাতার, গাছপালা
আলপথে নেমে আমরা যাচ্ছিলাম
ধানক্ষেত ভেঙে আমরা যাচ্ছিলাম
ছোট বোন আর মা-বাবা, গ্রামের লোক
তার পাশে আমি, দুলালী? না প্রিয়বালা?
বাবা-মার-র ডাক বাড়িতে দুলালী ব’লে
প্রিয়বালা নাম দিয়েছিল পাঠশালা
দু-তিন ক্লাসের লেখাপড়া সবে শুরু
গ্রামে কে বলল: ‘পালা রে সবাই, পালা...’
সারা গ্রাম নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলাম
মা-বাবা, দু-বোন, পালিয়ে যাচ্ছিলাম 
ঝোঁপঝাড় ঠেলে, হাজামজা নদী ঠেলে
পথে ঘুমন্ত দাঁড়িয়ে খড়ের চালা
ঘুমন্ত বেড়া, চালে ঘুমন্ত লাউ
উঠোনে শোয়ানো গরুর গাড়ির চাকা
শোয়ানো লাঙল, দাওয়ায় শিউলি গাছ
ঘোড়া নিমগাছে চাঁদ অর্ধেক ঢাকা।
শব্দ না করে চলে যাই, তবু ডাল
নিচু হয়ে এসে ছুঁয়েছে কপাল, মাথা
শিশিরে ঠান্ডা, ভেজা আর খসখসে
হাতের পাতার মতনই গাছের পাতা
কত কত মাঠ পার হয়ে তারপর
জিরিয়ে নিয়েছি গাছেরই তলায় বসে
যে যার পোঁটলা খুলে চিঁড়ে গুড় মুড়ি...
শেষে চোখ লেগে এসেছে ক্লান্তি-দোষে।
আচমকা দেখি ছোটাছুটি করে লোক
কীভাবে আগুন লেগে গেছে গ্রামে গ্রামে
কইরে আদুরী? ও দুলালী, তোরা কই?
মা-বাবা ডাকছে আমাদের ডাক-নামে।
আমি রইলাম, আদুরী ছিটকে গিয়ে
কোথায় পড়ল, কেউ জানল না কিছু
আমরা সবাই কাঁটাতার পেরোলাম
আমরা সবাই, ঘার নিচু, মাথা নিচু
খাতা পেরোলাম, ইমিগ্রেশন খাতা
লঞ্চ পেরোলাম, তারপর ট্রেন পথ
কোন এক দেশে আমরা যাচ্ছিলাম
যত গেছি তত ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে পথ
কোথায় সে দেশ? অতীতে? ভবিষ্যতে?
সে কোন বয়স আমরা ছেড়ে এলাম
দুলালী, দুলালী- প্রিয়বালা, প্রিয়বালা
রাস্তায় পড়ে হারিয়ে গিয়েছে নাম।
খানিকটা নাম ধানক্ষেতে পড়ে গেছে

খানিকটা গেছে নদীজলে, আঘাটায়
খানিকটা নাম নিয়ে নিল পাঠশালা
খানিকটা গেল রাস্তার দাঙ্গায়।
যে গাছের নিচে জিরোতে বসেছিলাম
খানিকটা নাম সেই গাছটায় আছে
খানিকটা নাম মাঠের শিশির নিল
খানিকটা গেছে রাত-পড়শির কাছে...
খানিকটা নাম বেড়ায় আটকে গেল
খানিকটা গোঁজা রইল খড়ের বাতায়
খানিকটা নাম কাঁটাতারে-তারে বেঁধা
খানিকটা যায় ইমিগ্রেশন খাতায়
একটা বয়স সে দেশে ছেড়ে এলাম
একটা বয়স নিয়ে ছেড়ে দিল স্বামী
একটা বয়স ছেলে বড় করে শেষ
ছেলে নামেই আজ চেনা দিই আমি।
আজ চারদিকে ফ্ল্যাট বাড়ি, ফ্ল্যাট বাড়ি
আজ চারদিকে বস্তি বস্তি লোক
লাইনের পাশে বাঁশ দরমার ঘর
ঘর থেকে আসে কাজ করা মেয়েলোক।
ঠিকে ঝি ছিলাম, এখন রাত-দিনের
খাওয়া পরা পাই এখানে, ফাইভ সি-তে,
ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়েছে, আমি
এখানেই থাকি গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতে...
এইখানে বসে, আমি নন্দর মা,
ছেলেকে ভাবি না, ভাবি না স্বামীরও নাম
শুধু মনে পড়ে আমরা যাচ্ছিলাম
সেই কোন দেশে পালিয়ে যাচ্ছিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল গাছপালা
যাচ্ছিল চাঁদ, সার সার চালাঘর
ঘরে কে আগুন দিয়ে বলেছিল, ‘পালা’-
পর পর লোক, পোড়া গ্রাম পরপর
পর পর ছাদ, পর পর অ্যান্টেনা
ছাদের মাথায় ভাসছে চাঁদের থালা
থালা কে বলেছে? তোমরা কি জানতে না
পোড়া গ্রাম ওই একচোখে চাঁদে জ্বালা?
না কেউ জানে না, ভুলে গেছে, ভুলে যায়
পরপর বাড়ি উঠে মাটি ফুঁড়ে
পরপর গাড়ি ছুটে যায় বোবা কালা
গ্রাম-পোড়া ছাই এখনো আসছে উড়ে।
দেয়ালে লাগছে, জানালায়, দরজায়
ফুলঝাড়ু হাতে কে পরিষ্কার করে?
কে বাজারে যায়? কে আনে ভাতের থালা?
কে এত কালের রোদ, বৃষ্টিতে, ঝরে
অযত্নে বাঁচে? যে নিজেই গাছপালা?
কী গাছ? কী গাছ? বলো বলো ফ্ল্যাট বাড়ি,
বলো পোড়া চাঁদ, বলো সব বোবা কালা
নন্দর মা কি দুলালী, না প্রিয়বালা?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //