অ্যারন শ্যুরিনের কবিতা

অ্যারন শ্যুরিন এই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান কবি। ১৯৪৭ সালে তিনি নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতার নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ক্যালফোর্নিয়ার নিউ কলেজ থেকে। গদ্য, পদ্য মিলিয়ে তার প্রকশিত গ্রন্থসংখ্যা ১৪টি। 

‘ইনটু ডিস্টেন্সেস’ তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ, বের হয় ১৯৯৩ সালে। সম্প্রতি মিশিগান ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে তার গদ্যগ্রন্থ ‘দ্য স্কিন অব মিনিং : কালেক্টেড লিটারেরি অ্যাসেজ অ্যান্ড টকস’। ২০১২ সালে বের হয় তার গদ্য কবিতার সংকলন ‘অ্যা কালেকশন অব প্রোজ পোয়েমস’। চল্লিশেরও অধিক আমেরিকান ও আন্তর্জাতিক জার্নাল, সাহিত্য পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে। এসবের মধ্যে নিউইয়র্কার, পোয়েট্রি ম্যাগাজিন, নর্টন অ্যান্থলজি অব পোস্টমডার্ন আমেরিকান পোয়েট্রি, নিউইয়র্ক রিভিউ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবিতার জন্য ক্যালিফোর্নিয়া আর্ট কাউন্সিল তাকে অনুদান এবং ফেলোশিপ দিয়েছে। তিনি সান ফ্রান্সিস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আর্ট ডিরেক্টর। বর্তমানে তিনি প্রফেসর ইমেরিটাস, পড়াচ্ছেন সান ফ্রান্সিস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে। অ্যারন টানা গদ্যে লিখতেই অধিক স্বচ্ছন্দ। কবিতায় তাকে পাওয়া যায় একজন আবিষ্কারকের ভূমিকায়। তিনি ভাষার অন্তর্গত শক্তিকে তুলে আনেন অনেকটা খনি-শ্রমিকের মতো এবং তা পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন নন্দনতত্ত্বের সর্বোৎকৃষ্ট আবরণ ও আভরণে সাজিয়ে। তিনি যখন বলেন, ‘খোসা ছাড়াবার আগে ফলের আর্তনাদ শুনো’ তখন আমরা শুধু একজন দক্ষ কাব্য-শিল্পীকেই পাই না, পেয়ে যাই এক মানবিক কবিকেও।

একদিনে যেমন তার শব্দেরা অভিজ্ঞতাসঞ্জাত, উঠে আসে জীবনের খুব গভীর থেকে, অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতার আলোয় প্রোজ্জ্বল। একদিন জিজ্ঞেস করি, ‘খুব বুঝি রুমি পড়েছেন?’ একেবারে দ্রুত এবং দ্বিধাহীন জবাব ‘অবশ্যই’। টানা গদ্যে লেখা নিয়ে তার কোনো দ্বিধা বা সংশয় নেই, থাকার কোনো কারণও নেই এই আমেরিকায়, যেখানে পাঠক কবিতার অন্য যে কোনো ফর্মের মতো টানা গদ্যে লেখা কবিতাকেও সমানভাবে গ্রহণ করেছে। যদিও তিনি বলতে পছন্দ করেন গদ্যে ভাষাকে নিয়ে খেলার স্বাধীনতা অনেক বেশি কিন্তু আমরা তার গদ্য কবিতায় কোনো বাহুল্য দেখি না। সম্প্রতি আমি তার একটি ছোট সাক্ষাৎকার নিই এবং কিছু কবিতার অনুবাদ করি, নিচে তা উপস্থাপন করা হলো

এই যে আপনি কবিতার লাইন না ভেঙে টানা গদ্যে লিখছেন, এর কি বিশেষ কোনো কারণ আছে? আসলে আমি জানতে চাইছি কেন আপনি টানা গদ্যে বেশি লিখছেন? এ ধরনের কবিতা কি আমেরিকার পাঠকের কাছে আদৃত?

টানা গদ্যে কবিতা লেখার একটি সুদৃঢ় পরম্পরা আছে আমেরিকায়। গার্ট্রুড স্টাইন এবং উইলিয়াম কার্লোসের কাল থেকেই এর শুরু। কবিতার অন্য যে কোনো ফর্মের মতোই, গদ্যে রচিত কবিতাও, একইভাবে মার্কিনি পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সমাদৃত। আমি আমেরিকান কবিদের মধ্যে গদ্যে লেখা কবিতা নিয়ে কোনো টেনশন দেখি না, উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আমার এক রাশিয়ান বন্ধু আমাকে বলেছে, গদ্যে রচিত কবিতাগুলোকে রাশিয়ার অনেক কবি এবং পাঠক কবিতাই মনে করে না। আমি গদ্য ফর্মের প্রতি অধিক আকৃষ্ট এর ব্যাপ্তির কারণে, এর ধারণক্ষমতা, বিস্তার ঘটানোর অধিক সুযোগ, যাকে আমি আসলে বলতে চাই বৃহত্তায়ন, যে সুযোগটা পদ্যে কম, ওখানে পঙ্ক্তির মধ্যে শব্দগুলো খুব নিয়ন্ত্রিত থাকে কিন্তু গদ্যে স্বাধীনতা অনেক বেশি।

কবিতার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তাকে আপনি কীভাবে দেখেন? জনপ্রিয়তা কি মানদণ্ডের কোনো ইন্ডিকেটর? 

পাঠক এবং প্রশংসার বিবর্তনের মধ্যে কবিতা বাস করে, কবিতার পাঠক তৈরি হতে সময় লাগে। হয়তো এখন কোনো কবিতার পাঠক খুব কম কিন্তু দশকের পর দশক ধরে সেই কবিতার পাঠক তৈরি হতে থাকে। বিশেষ কোনো উপলক্ষে বা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়শই কোনো কোনো কবিতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে; কিন্তু সময় বদলে গেলে সেই কবিতা তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে। হঠাৎ ফুঁসে ওঠা কোনো শৈল্পিক আন্দোলন বা বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে এটি বিরল দৃষ্টান্ত যে কবিতা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কবিতার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা প্রায় বিপরীতার্থক অলংকার। সম্ভবত এর চেয়ে কম জনপ্রিয় শিল্পের আর কোনো শাখা নেই। 

কত কপি কবিতার বই বিক্রি হলে আমরা বলতে পারি যে ভালো বিক্রি হয়েছে? অন্যভাবে বলা যায়, আমেরিকায় কত কপি বই বিক্রি হলে, কবিতার ক্ষেত্রে, বেস্টসেলার বলা যায়?

বেস্ট সেলার কবিতার বই খুঁজে বের করা কঠিন, যদি না ক্লদিয়া র‌্যানকিনের মতো হঠাৎ সময়োপযোগী কোনো ঘটনা ঘটে যায়, অথবা সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে আমান্দা গর্মেনকে তুলে ধরা হলো, এমন কোনো ঘটনা ঘটে। সাধারণত আমেরিকার ছোট ছোট প্রকাশকরা কবিতার বই বের করে। তারা ৭৫০ থেকে ২০০০ কপি বই ছাপে। এটাই আমেরিকার কবিতার মার্কেট। 

একজন কবি শুধু কবিতা লিখে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, আমেরিকায় বা পৃথিবীর অন্য কোথাও?

আমি অন্য দেশের কথা জানি না কিন্তু আমেরিকায় এটা একেবারেই অসম্ভব। প্রায় সব কবিই এখানে তার জীবিকার জন্য শিক্ষক তা করে, আমিও করি। মাস্টার্স অব ফাইন আর্টসের রাইটিং প্রোগ্রামের কারণেই কবিরা জীবিকার জন্য খুব সহজে শিক্ষকতায় ঢুকে পড়ছে। 

একজন তরুণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় কবি রুপি কাউরের কবিতার বই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। আপনি কি তাকে একজন প্রধান কবি মনে করেন? প্রধান কবি শনাক্ত করার উপায় কী? 

আমার মতে প্রধান কবির কাজের মধ্যে নন্দনতত্ত্বের স্বাদ পাওয়া যায়, নতুন আবিষ্কারের খোঁজ পাওয়া যায় এবং তার প্রভাব অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আমি এটাকে বিবেচনার মধ্যেই নিই না, কয়টা গোলগাপ্পা বিক্রি হলো। এটা খুব কঠিন বলা যে কে ‘প্রধান’ কবি বা কোন কবিতাগুলো প্রধান কবিতা। এটা হয়তো, কবিতার গভীরতা, সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি, শেকড়-সন্ধান, সংস্কৃতির মূল অনুসন্ধান, সংবেদনশীলতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে কিন্তু তা কিছুতেই বিক্রির পরিমাণ দিয়ে মাপা যায় না। রুপি কাউরের কবিতা আমি পড়িনি, তাই মন্তব্য করতে পারছি না।

২০২০-এর নোবেল জয়ী মার্কিন কবি লুইস গ্লুকের কবিতা নিয়ে কি আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি?

 না, পারেন না। সত্যি বলতে কি আমি তার কবিতা তেমন একটা পড়িনি। 

আপনি কি মনে করেন, একজন কবির খুব স্ট্রং সোশ্যাল কমিটমেন্ট থাকা জরুরি?

আমি মনে করি সামাজিক দায়বদ্ধতা শুধু একজন কবির কেন, প্রতিটি মানুষেরই থাকা জরুরি। একজন কবির মূল চ্যালেঞ্জটা হলো, সময়কে ধারণ করা এবং তাকে কবিতা করে তোলা, স্লোগান রচনা করা নয়। দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে, আপনি একজন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে চান এবং সাধারণ মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে চান। এই কথাগুলো উচ্চারণের জন্য কবিতার পঙ্ক্তি সম্ভবত একটি শক্তিশালী হাতিয়ার নয়, কবিতা নিমগ্নতার বিষয়। ইতিহাস বদলের চাপ কবিতায় উপস্থাপন করাটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ যখন কবিতা প্রত্যাশা করে কবির উন্মুক্ত কান যেখানে নতুন আবিষ্কারের কল্পনা বাজতে থাকবে। একইসঙ্গে এইসবের সমন্বয় ঘটানো সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কবিতারও। 

খুব সাধারণের জন্য, একদম সহজ করে বলবেন কি উত্তরাধুনিকতা জিনিসটা কী? 

‘উত্তরাধুনিকতা’- এই টার্মটা শিল্প-সাহিত্যে প্রায়শই উচ্চারিত হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কেউই জানে না এটা আসলে কি জিনিস। খুব ঢিলেঢালাভাবে যদি বলি, কুড়ি শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ অবধি সময়কালের শিল্পকর্মকে, বিশেষ করে সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট শিল্পকর্মকে, ইন্ডিকেট করা হয়, যে সময়টাতে কিছু একটা নির্মিত হয়েছিল। হতে পারে একটি সামাজিক বোধ তৈরি হয়েছিল (সমকামিতা, নারী অধিকার, মিশ্রবর্ণের সহাবস্থান বা গ্রহণযোগ্যতা) অথবা শুধুই ভাষার নিজস্ব একটা নির্মাণ ঘটেছিল এই সময়ে। 

বাংলা কবিতায় আধুনিকতা মূলত শুরু হয় ত্রিশের দশকে এবং এর মূল বৈশিষ্ট্যটা ছিল গদ্যে লেখা, পশ্চিমকে অনুসরণ করা। আশির দশকের শেষের দিকে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে তরুণ কবিরা বিপ্লবী হয়ে ওঠার চেষ্টা করল, পশ্চিমের প্রভাব কবিতা থেকে মুছে ফেলে শেকড়ে তাকাল, এটাকেই আমাদের এখানের কবিরা বলতে চাইল উত্তরাধুনিকতা। এই বিষয়ে আপনার কোনো মন্তব্য আছে কি?

আমেরিকার সাহিত্যে আধুনিকতার যুগ শুরু হয় কুড়ি শতকের গোড়ার দিকেই, এজরা পাউন্ড, গার্ট্রুড স্টাইন এবং আলফ্রেড জয়েসদের হাত ধরেই আসে আধুনিকতা। আর উত্তরাধুনিকতা নিয়ে যা বললাম এর বেশি আর কিছু আমার জানা নেই। 

আমেরিকার কবিদের মধ্যে এখন কী ধরনের ধারা চলছে? বিশেষ কোনো কাব্যান্দোলন, বিশেষ কোনো ধারায় কবিতা লেখার ঝোঁক?

ধারা, যদি কিছু থেকেই থাকে, তা হচ্ছে পুরনোকে অস্বীকার করা, তবে এর কোনো নাম নেই। ব্ল্যাক আর্ট এবং ল্যাটিনো মুভমেন্টে প্রচুর কাজ হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, চিন্তার বৈচিত্র্য এবং সম্ভাব্য অডিয়েন্সের দিগন্তটা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। যা আমেরিকার কবিতার ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে, বিষয় বৈচিত্র্য তৈরি করেছে এবং নান্দনিকতার বিস্তার ঘটিয়েছে, বলা যায়, কবিতার অঙ্গনটা এখন অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।

অ্যারন শ্যুরিনের একগুচ্ছ কবিতা 

পলকা
অভিভূত ওর প্রতি, ওর দ্বারা, যেখানে স্রোতেরা মেশে, যে নিজেই একটি শূন্যতার মোহনা, অস্থির আঁধার, প্রহরী কুকুরের নিমগ্ন-অধশব্দতরঙ্গের ধ্যান, ছুটে চলেছে ওর মা কিংবা নানির কাছে, ওর লকেটে যারা লিখে দিয়েছে, ‘ব্লেডের ওপর দিয়ে হেঁটো’ এবং ‘খোসা ছাড়াবার আগেই ফলের আর্তনাদ শুনো’। এ নয় সৌভাগ্য পূর্ণতার, শক্ত খোলসও নয়, শুধু অব্যক্ত অনুভূতি ব্যর্থ করে দেয়া অথবা সুবাসিত নির্যাসের বিদায়। পুরোটা সময়ই সকাল, সর্বদাই দুপুর কিংবা অনড় সন্ধ্যা- আসলে সময় লুট হয়ে যায়- একটা জাদুর ব্যাগে প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী ভ্যাকুয়াম টেনে নিচ্ছে সবকিছু, খুব ভারী একটা ব্যাগ, হাতের মধ্যেই, সেখান থেকেই আবার সকলে একসঙ্গে, যেন মৌচাক থেকে টেনে বের করছি টেলিপ্যাথিক মৌমাছিদের; এবং সবুজ একটি পাত্রে ওদের অবস্থান; নগর মুদ্রিত হচ্ছে পাথরের রাস্তায়, বৃহৎ এক পাত্রে ফুটছে জীবন, এবং গুহার মুখেও। সম্ভবত এটাই আমার বুনন, আমার ভূত-বিচরণক্ষেত্র অথবা আলোর পালক। আমরা একে-অন্যকে জড়িয়ে ধরি ময়ামের পাত্রে যখন আমাদের একত্রে দলাই-মলাই করা হয়; আমরা সকলেই যুক্ত।

ঠাণ্ডা ধুলো
বিকেলের এক ফালি আলো ঘাসের গালিচা থেকে টেনে তোলে টিউলিপ, ঘাসফড়িঙের আশ্রয়, যেন এক ঝিনুকের পেয়ালা। ফার্মহাউজ কাৎ, চাকার ওপর একটি বক্র ছায়া। সেডার রুমে সেঁটে আছে পুরো পরিবার, নিস্তব্ধ, ইস্পাত-দৃষ্টির তারে পেচানো, বাকরহিত, রোমান্টিক ছাই। এ গৃহ আমার নয়, আমার আত্মার; অনাহুত অতিথি, আমার ভালোবাসার শ্রম, শ্যাওলা অথবা গ্রিজ, আমার জেপিইজি ছাপ, কাচা চামড়ার। অন্তর্গত অঙ্গের মতো বেজে ওঠে হলুদ বাতি, নরোম দেহে পোকাদের প্রিলিউড, নতুন এক পৃথিবীর অঙ্কুরোদ্গম, আমার ঘরের দোলায়িত জানালায় কার ভবিষ্যৎ অপেক্ষমান? সম্ভবত এখানে আটকে থাকে সময়, আমার মাংসপেশির ব্যথার মতো, জড়িয়ে আছে কাঁধে; পাকানো দড়ি, পেঁচানো ম্যাপল গাছে, আমার কাণ্ডটি চুড়ির মতো গ্রহের প্রান্তরেখা ছুঁয়ে তৈরি করছে লাল বৃত্ত। রাঙা-ধুলো, বাতাস দিয়ে দিয়ে আমি ঠেলে দিচ্ছি সামনের দিকে, ভেনিলার সুগন্ধ মাখা একটি নাশপাতি ভাসছে অথবা পড়ে যাচ্ছে। সামনের দরোজায় ফুলে ওঠা বোর্ডে আঁকা প্রহরী আমাকে দেখছে। শীতল ধুলোরা উড়ছে এবং বসে পড়ছে। ছায়া আমাকে স্পষ্ট করে তোলে। একটি শূন্য ওয়াগন জ্বলে ওঠে পাহাড়ের গায়ে। 

আলোর পরিমাপ
নগর-সৈকতে ভালোবাসার এমন তীব্র উপস্থিতি আলোর পরিমাপ নির্দেশ করে, যখন বাতাসেরা ছুটে চলে পুরুষের কামুক জিহ্বার মতো। ঝিকমিক করা জলের ফোটায় আমার দৃষ্টি সতেজ হয় এবং জলবিন্দু, এবং সেইসব পুরুষেরাও, যারা আমার ঔজ্জ্বল্যের প্রতিভূ...উঁচু ম্যাপল পাতার ছায়ায় বসে পরিবারগুলো ভোজ-উৎসবে ব্যস্ত। যদিও শব্দেরা, আলো-সংগীতের, কোথাও আটকে আছে, অথবা সি-গাল পাখিদের উষ্ণ আর্তনাদ, যারা আমারই জিহ্বা, যেহেতু ওরাই পরিমাপ করে আমার ভালোবাসা এবং সূর্য গিলে ফেলে তার নমিত তাপ...ভিড়ের ভেতরে, রঙিন শর্টসের ঢেউয়ে এবং কমলা রঙের ছাতার নিচে গ্রীষ্ম। মুখে বিস্তৃত হাসি নিয়ে এবং আঁটসাট টি-শার্ট পরে হেলেদুলে হেঁটে চলা পুরুষদের দুলতে থাকা নিতম্ব দেখে মনে হয় ওরা নিম্নাসনে উপগত...বুনো ধীর, দীঘল দিবস...নীল মেঘের আড়ালে বকের দল দুলতে দুলতে ভিড় করে ওদের পাগুলো পেছনে রেখে এবং গ্রীষ্ম লম্বা দিনের আলো গুটিয়ে নেয়, মেঘেরা তাদের নীল পাল তুলে দেয়-

এখনো হাঁটছে
আকাশের দিকে তাকাও : সম্ভাব্যতার তীব্র ঘ্রাণ। আমার চোখের দিকে তাকাও : ওরা আকাশের যন্ত্রাংশ। আমার পায়ের দিকে তাকাও : এখনও হাঁটছে। ‘তুমি কোনদিকে হাঁটছ?’ পাখিকে জিজ্ঞেস কর, ‘তুমি কি গাইছো?’ একটি হন্টন সংগীত। ‘এটা কীভাবে বয়ে চলে?’ পাখি, গম্বুজ, গোলাপি, মৃদুবায়ু... চিন্তার আলো বর্ণমালা-বৃক্ষে...এবং এমন আরো অনেক কিছুতে...আমার হাসি দেখো: সে ওপরে উঠে ডানে চলে যায়। এটা কি আমার ব্যাকরণগত কোনো চতুরতা, সুনির্বাচিত কোনো চিহ্ন, আভিজাত্যের কম্পনরেখা, যৌন উদ্দীপক? সব কিছুই, শুধু কবি ছাড়া। একটি লোককে আমি একতোড়া ফুল কিনে নিয়ে ছন্দের তালে তালে হেঁটে যেতে দেখি। আচমকাই সে ধাঁ করে চলে গেল; সুখের হাতছানি ওকে ইশারা দিল এবং ঠোঁটের ডানদিকে হাসির আভাস ফুটে উঠলো। ‘‘সে কি গাইছিল?’’ একটি ছন্দোবদ্ধ গান। ‘‘কেমন হচ্ছিল তা?’’ ছন্দের উঠানামা। ‘‘আহ, পৃথিবী এক রঙ্গমঞ্চ,’’ পৃষ্ঠার দিকে তাকাও।

একটি গানের নির্মাণ
সে উঠে দাঁড়াল এবং হাঁটতে থাকল এবং তৈরি হলো একটি গান: ‘ছোট বুদ্ধ মেঘের নিচে, উপবেশন থেকে উঠে দাঁড়ায়, এতে কি ঘটে?’ এবং তখন, ‘নিচে, মাটির আসনে বসে থাকা হে মহান নারী- সব কিছুই শুদ্ধ’। নারী ভাবে, ‘না, এখানে শুদ্ধতা কোথায়?’ এবং আরও একটু এগোয়...নারী, বুদ্ধ, মেঘ, আসন, ভাসছে, হাঁটছে ছায়ারা উঁচু বাতাসে: যেমন দেখি আমি, পর্দা, দুশ্চিন্তা, স্বপ্ন, কর্ম, ভাষা, আমার ধারণায় তোমার উপস্থিতি, যদিও উঁচুতে, আমি নতজানু, খুঁজি অদেখা ধূলিকণা, এবং তাকেই ঘরে নিয়ে আসি আকাশের ভেতর থেকে, আমার পথপ্রদর্শক...আমি সরে যাই এবং হামাগুড়ি দিই, মাতৃবায়ুর পুতুল অন্য পুতুলগুলো ভিন্ন বাতাসে দোলায়। এখানেই আমি নাচি, বসি, তাই আমি দেখেছিলাম এবং দেখি, যা আমাকে দেখানো হয়েছে- অথবা দেখো, আমি শূন্যতাকে ছিঁড়ে ফেলি, ছিঁড়ে ফেলি ঘন মেঘ, বুদ্ধ এখন ওজন-চাকায় চড়ে বসে, ওদের মুক্ত করে এবং শেখায় গ্রন্থের বিদ্যা- যা সর্বাদা ক্ষুধা বাড়ায়- ছিঁড়ে ফেল গ্রন্থ, ঠেসে দাও সংগীতে, সবকিছু ঠেসে দাও সব কিছুর ভেতরে...এবং হাঁটো, হেঁটে যাও খানিকটা আরও...

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //