ওএইস্টল্যান্ড: কবিতার ধারণাকে চূর্ণবিচূর্ণ করা কবিতা

পৃথিবীর এক তুষারাবৃত অঞ্চলে শীতের ওমের ভেতরে গভীর নিদ্রা আর একাকার করা কামবাসনার স্মৃতি বসন্ত-বৃষ্টির বিস্মৃত পরশ এনে দেয়। আচম্বার সঞ্চার করা এই অনুভূতির সাথে পরিচয় ঘটতে না ঘটতেই আমরা পরিচিত হই একজন স্থিতধী মানুষ কোনো এক দখিনা শীতের দেশে পাড়ি জমানোর অভীপ্সা থেকে রাত কাটিয়ে দেন বই পাঠ করে।

কেননা বন্ধ্যা অঞ্চলটির মানুষ বাকরুদ্ধ, কোনো শাখামূলের জন্ম হয় না সেখানে, সূর্যও বড়ই দুঃসাহসী, শুষ্ক বৃক্ষ দেয় না কোনো ছায়াশ্রয়, দেয় না ঝিঁঝিঁ পোকারাও কোনো স্বস্তি অথবা কঠিন শিলাতে  শোনা যায় না কোনো জলস্রোতের শব্দ।

ভীতিকর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতিই মূলত ভড়কে দিয়েছে স্থিতধী মানুষটিকে তো বটেই, পুরো অঞ্চলটিকেও। সময় ও প্রকৃতিকে অস্পস্টভাবে প্রতিবিম্বিত করা এবং নিজের যুৎসই স্মৃতির রোমন্থন করা স্থিতধী সেই মানুষটি আর কেউ নন, বিশ্বসাহিত্যের প্রধান কবিদের একজন টমাস স্টার্ন এলিয়ট।

বেরিয়াল অভ দ্য ডেড, আ গেইম অভ চেস, দি ফায়ার সারমন, ডেথ বাই ওয়াটার আর হোয়াট দ্য থান্ডার সেইড, পাঁচটি অংশে বিভক্ত ভুবনজয়ী কবিতা দি ওএইস্টল্যান্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে একশো বছর ধরে ওএইস্টল্যান্ড এতটাই আলোচিত যে কবিতার আলোড়িত বাগানে সকলেই কমবেশি এলিয়টকে দেওয়া এজরা পাউন্ড-এর দু’টি পরামর্শের ব্যাপারে জ্ঞাত।

উল্লেখ্য, ওএইস্টল্যান্ড প্রকাশের সময় এলিয়ট তার স্ত্রী ভিভিয়েনের থেকেও নানান পরামর্শ নিয়েছিলেন। এজরা পাউন্ড-এর দেয়া পরামর্শ দু’টি হলো: কবিতাগুলো থেকে দীর্ঘ অংশগুলো বাদ দিয়ে ঘণবিন্যাসে সাজানো, এবং ছন্দ-বিন্যাসকে ভেঙ্গে ফেলা।

এজরা পাউন্ডকে ওএইস্টল্যান্ড উৎসর্গ করেছেন এলিয়ট। বলা হয়ে থাকে ওএইস্টল্যান্ড বদলে দিয়েছে কবিদের ভাবনাচিন্তার গতিপথ; কিন্তু এটা যদি বলা হয় তাহলে এলিয়টকেই প্রশ্নবিদ্ধ না করেও করা হয়। কেননা, এলিয়ট তাঁর ট্রেডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট-এ বলেছেন, যে আমরা আজও যা কিছু লিখি তা কোনো না কোনোভাবে পূর্বের কবিদের থেকে ধার-দেনা করা।

তবে, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় বিশ শতকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার একটি ওএইস্টল্যান্ড পাঠ করার কালে সকলকে কমবেশি বিস্ময়াবিষ্ট হতে হয়। আমাদের এটা ভেবেও বিস্ময়াবিভূত হতে হয় যে কি নেই আর কি হাজির করেননি এলিয়ট তাঁর ওএইস্টল্যান্ডে!

রিকালেকশন থেকে যে প্যাশন আসে সেটা সুন্দর। আর এই প্যাশন থেকে ওএইস্টল্যান্ড-এর পঙক্তির পর পঙক্তিতে আমরা দেখতে পাই তিনি মানবতার প্রতীক টাইরেসিয়াস থেকে শুরু করে মিউনিখের হফ্গার্টেন; পরিবার, সম্প্রদায় ও বন্ধনমুক্ত সমাজে শিকড়হীনতার প্রতীক জার্মান মেয়ে মেরি; ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে এজেকিয়েল, অ্যাক্লিসিয়াস্তেস; খ্রিস্টানদের গির্জার প্রতীক লাল পাথর; রিচার্ড ওয়াগনার-এর হেরমান অপেরার ত্রিস্তান অ্যাণ্ড আইসোলদের প্রিয়ার জাহাজের চিহ্নমাত্র না পেয়ে প্রেম আর প্রিয়ার জন্য মুমূর্ষু প্রেমিক ও নাবিক ত্রিস্তানের গান; গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া আর তার রক্ত থেকে একটি ফুলের জন্ম হওয়া উর্বরতার দেবতা তথা পুনরুত্থানের প্রতীক হায়াসিন্থ; হাক্সলির জি ক্রম ইয়োলো উপন্যাসের মিথ্যা ভবিষ্যদ্বক্তা মাদাম সোসোসট্রিস; মিসেস একুইটোন তথা ম্যাডাম সোসোসট্রিসের মক্কেল; অঙ্কিত চিত্রের মাধ্যমে দৈবঘটনা বর্ণনাকারী ট্যারোট প্যাক তথা একপ্রকার অভিশপ্ত তাস; গ্রীষ্মকালে মৃত্যু সংকেত প্রদান করার জন্য সমুদ্রে ফেলা উর্বরতার প্রতীক ফিনিশীয় নাবিকের মূর্তি; অশুভ ভাগ্যের প্রতীক পর্বতের রমণী; অভিশপ্ত তাসের ফাঁসিতে লটকানো লোক, নির্বোধ একচোখা বণিকসহ দুনিয়ার নানান বিষয় ও বস্ত হাজির করে আমাদের পুরো পৃথিবীটাই যেন পরিভ্রমণ করান।

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রিফেইস টু দি লিরিক্যাল ব্যালাডস গ্রন্থটিতে বলেছেন, কবিতা হলো শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ অবশ্য কবিতাকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য আর কবিতায় সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের বিষয়বস্তু প্রতিনিধিত্ব করা উচিত বলেছেন। কোলরিজ আবার বায়োগ্রাফিয়া লিটেরারিয়া গ্রন্থে দর্শনকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করার কথা বলার পাশাপাশি কল্পনার সর্বোচ্চ প্রয়োগের কথাও বলেছেন।

এদিকে ম্যাথ্যিউ আর্নল্ড কবিতাকে বলেছেন জীবনের সমালোচনা; কিন্তু ওএইস্টল্যান্ড-এ আমরা অনুধাবন করি এলিয়ট তাঁর কল্পনা, বুদ্ধিদীপ্ততা, আবেগের মিশেলে ইঙ্গিত, ইশারা, টীকা ও টিপ্পনি, মন্তব্য প্রভৃতির মাধ্যমে কবিতার পাঠককে নাস্তানাবুদ করেন।

বিশ্বসাহিত্যের মাস্টারপিসগুলো অধিক আলোচিত হয় সত্যি; কিন্তু এইসব সৃষ্টিকে স্বল্পপঠিত হওয়ার ভাগ্যও বরণ করতে হয়। শতবর্ষেও ওএইস্টল্যান্ড তুমুল আলোচিত তো বটে; কিন্তু এর দুরূহতা কম দায়ী নয় কবিতাটি পাঠকদের বোঝার ক্ষেত্রে। শার্ল বোদলেয়ারের সাতজন প্রৌঢ় মানুষ কবিতাটির ভিড়ের, স্বপ্নের তথা মায়াবি নগর; লা ফ্লার্স দ্যু মাল-এর শেষ পঙক্তি; লন্ডনের কিং উইলিয়াম রোড আর তার গির্জা; স্টেটসন টুপি প্রস্তুতকারক এক আমেরিকান; সিসিলির উত্তর উপকূলীয় প্রাচীন নগর তথা রোম ও কার্থেজের মধ্যে সংঘঠিত খ্রিস্টপূর্ব ২৬০ সালের যুদ্ধের নগর মাইলে; রোমান কবি অভিদের মেটামরফোসিস-এর টেরেউস আর তার স্ত্রী প্রোসন, টেরেউস কর্তৃক ধর্ষিত প্রোসনের বোন ফিলোমেল, ধর্ষিতা ফিলোমেল যাতে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করতে না পারে তার জন্য টেরেউস কর্তৃক ফিলোমেলের জিহ্বা কেটে ফেলা কিন্তু ফিলোমেলের এক টুকরো কাপড়ে ধর্ষণের ঘটনা লিখে বোন প্রোসনকে জানাতে সক্ষম হওয়া এবং টেরেউস কুঠার নিয়ে তাড়া করলে দেবতার ফিলোমেলকে বুলবুলিতে রূপান্তর করা প্রভৃতি সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক বিষয় ও বস্তু কবিতার নানান উপাদান দ্বারা ওএইস্টল্যান্ড-এ চিত্রিত করেছেন।

ফলে এটা বলতে আমাদের একপ্রকার বাধ্য হতে হয় যে যত দুর্বোধ্যই হোক না কেন এলিয়ট আর তাঁর মহাকবিতা ওএইস্টল্যান্ড, তিনি যেন খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন কবিতার পুরোধাদের অভিযাত্রা।

কত রক্ত কত ঘাম ঝরেছে এলিয়টের ওএইস্টল্যান্ড লিখতে, তা আমরা অনুমান করি মাত্র। এলিয়ট বলেন বুদ্ধ ও সেন্ট অগাস্টিন উভয়েই ইন্দ্রিয় প্রলোভনকে জ্বলন্ত আগুন বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রাচ্যের বুদ্ধ আর পাশ্চাত্যের সেন্ট অগাস্টিনের তপস্যাকে কোনো আলাদা ঘটনা হিসেবে দেখেন না।

সিদ্ধার্থ শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ’র রিপু ও পুনর্জন্ম থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির প্রতি বিরূপভাব বা চিত্তের বিশুদ্ধতা সাধনের অনুশীলনের পক্ষ যদি সমর্থন করেন; অন্যদিকে, সেন্ট অগাস্টিনের পরিত্রাণ লাভের জন্য ঈশ্বরের করুণায় বিশ্বাসও আলোকপাত করেন। এই সবকিছু আলোকপাত করার পাশাপাশি ওএইস্টল্যান্ড-এ আমরা দেখতে পাই একইসাথে নারী ও পুরুষ দেহ বিদ্যমান দীর্ঘ জীবন ও ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত টাইরেসিয়াস আর তার আত্মজ্ঞানকে উল্লেখ করতে।

এছাড়া এলিজাবেথের সময়ের কবিতায় হিরন্ময় কামনার দেবতাকে নির্দেশ করা পাখির গানের ধ্বনিরূপে হালকা রসিকতায় যৌন সঙ্গমের ইঙ্গিত ‘জাগ্ জাগ্’ দ্বিরুক্তির দর্শনও তিনি আলোকপাত করেন। তবে এত সবকিছু ছাপিয়ে মূলত ক্রোধ-ঘৃণা-অনুরাগের বিরুদ্ধে গৌতম বুদ্ধ’র ‘অগ্নিসূক্তি’র হাটবাজারকেই আলোকপাত করেন এলিয়ট তাঁর ওএইস্টল্যান্ড-এ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //