কাজী জহিরুল ইসলামের ভুবন

ফেসবুকের কল্যাণে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা চোখে পড়ে কাজী জহিরুল ইসলামের। পাশাপাশি লিখছেন নিবন্ধ, নিচ্ছেন কারোর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার অথবা সঞ্চালক হিসেবে পরিচালনা করছেন ফেসবুকে লাইভ কবিতা পাঠের আসর, তার ওপর নিউইয়র্কে জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি। একজন মানুষ কী করে এত নানামুখী কাজ সুচারুভাবে পালন করতে পারেন, কাজী জহিরুল ইসলামকে না-দেখলে আমি বুঝতে পারতাম না। 

এই উজ্জ্বল কর্মঠ মানুষকে আমি প্রথম দেখি পূর্ণিমা পত্রিকার অফিসে। সালটা সম্ভবত ১৯৯১। পত্রিকাটির সার্বিক দায়িত্ব আমার হাতে। এক ব্যস্ত দিনে কালচারাল রিপোর্টার দুলাল খানের সঙ্গে এসেছিলেন কাজী জহিরুল ইসলাম। আমি তাকে বললাম, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের নিয়ে অফ-ট্রাকের রিপোর্ট চাই। আপনি কি পারবেন? 

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে জহির এ-প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছিলেন তা এ মুহূর্তে হুবহু মনে নেই, তবে তার সপ্রতিভ চাহনির মধ্য দিয়ে আমি ইতিবাচক জবাবই খুঁজে পেয়েছিলাম। আজ খোলামনে বলতে চাই যে কাজী জহিরুল ইসলামের মাধ্যমে আমি পূর্ণিমার সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পীকে নিকটতম সম্পর্কে টেনে আনতে পেরেছিলাম।

তার মূল চাকরি ছিল বিদেশি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়। দিনের বেলায় সেখানেই কাজ করতেন। অফিস শেষে রিপোর্টিংয়ের জন্য যাবতীয় তথ্য ও লেখক-শিল্পীদের খবরাখবর জোগাড় করে সোজা চলে আসতেন পূর্ণিমায়। কাজ শেষে রিপোর্ট জমা দিয়ে চলে আসতেন আমার রুমে। 

সেখানে যুক্তি-পাল্টা যুক্তিসহ জমে ওঠা তুখোড় আড্ডায় অংশ নিতেন এই নবীন সদস্য। সৈয়দ মনোয়ার হেসেন ও আবু করিমের মধ্যেই তর্কটা হতো বেশি। আড্ডায় রবি আরমান, ইরাজ আহমেদ, মাহফুজুর রহমান, পঙ্কজ পাঠকও থাকতেন সরব। এখানে এই আড্ডা চলাকালে কখনো আসতেন আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবদুল মান্নান সৈয়দ।

তবে নিয়মিত একবার করে অফিসে এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেতেন আল মুজাহিদী, সানাউল হক খান, শিহাব সরকার, ফাহিম ফিরোজ, মাহমুদ কাশেমসহ আরও অনেকে। আাড্ডায় জহির থাকতেন উচ্ছল। তার আরও একটি গুণ হলো কোনো কাজই তিনি ফেলে রাখতেন না, সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতেন। 

পূর্ণিমায় জহির ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী কন্ট্রিবিউটর। তারপরও মনে হতো না তিনি খণ্ডকালীন প্রতিবেদক। লিটারেরি ফ্লেভারের মিশেলে তার চমৎকার গদ্যরীতির কৌশল ছিল সত্যই প্রশংসনীয়। আল মাহমুদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দ তো প্রায়ই জহিরের রিপোর্টিং নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেতেন। তারা উভয়ই বলতেন, ছেলেটার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন, অসাধারণ গদ্যের হাত ওর।

কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয় জহিরের প্রতি। তারা চেয়েছিল তাকে নিয়মিত স্টাফ রিপোর্টার করে নিতে, কিন্তু আমার আপত্তির জন্য সে সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। আসলে আমি চাইনি সাংবাদিক হিসেবে জহির তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। এর কারণ হলো সাংবাদিকতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এক পেশা।

যে কোনো সময়ে চাকরি চলে যেতে পারে, এমনকি আর্থিক সংকটের জন্য পত্রিকার প্রকাশনাও অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জহির বিদেশি যে-স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরি করছিলেন, সেখান থেকে আরও ভালো জায়গায় যাওয়ার তার রয়েছে সুযোগ। আজ আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমার ওই সিদ্ধান্ত ছিল ঠিক। হ্যাঁ, কাজী জহিরুল ইসলাম জাতিসংঘের নিউইয়র্কের কেন্দ্রীয় অফিসে এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করছেন।

পূর্ণিমার সঙ্গে যুক্ত থাকাকালে একটি লিটল ম্যাগও বের করেছিলেন জহির। ছোট কাগজটির নাম দিয়েছিলেন ‘কাজীর কাগজ’। পাশাপাশি করতেন জসীম উদ্দীন সাহিত্য পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন। জহির আমাকে অনেকবার বলেছেন, আমি পূর্ণিমায় লিখি না, লিখি একজন মুক্তিযোদ্ধা আতাহার খানের কাগজে।

পরে জহির আমার অনুরোধে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায়ও বেশ কিছু গদ্য লেখেন। তখনো ওর একই কথা, আমি লিখি আতাহার ভাইয়ের কাগজে। জহির তার কলাম, প্রবন্ধ বা উপম্পাদকীয়তে এমন বিষয় তুলে আনতেন যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক। যখন তিনি পূর্ণিমায় কন্ট্রিবিউট করতেন, একই সঙ্গে দৈনিক জনকণ্ঠে লিখতেন।

যখন তিনি আমার দেশে কলাম লিখতেন, একই সঙ্গে প্রথম আলোতে নিয়মিত লিখতেন। এমনও দেখা গেছে একই দিনে আমার দেশ এবং প্রথম আলোতে তার লেখা উপসম্পাদকীয় বিভাগে ছাপা হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছিল, তিনি আমাদের অস্বাস্থ্যকর দলীয় রাজনীতি থেকে সব সময় দূরে থাকতেন এবং সব সময় সত্যিটা বলার চেষ্টা করতেন।

জহিরই প্রথম ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরির ধারণাটি দেন। কাজটি কীভাবে করা হবে এর বিস্তারিত পরিকল্পনা তার রচনায় ছিল। সেই লেখার পেপারকাটিং প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের টেবিলে টেবিলে ছিল। 

নানামুখী কাজ গুছিয়ে সুন্দরভাবে শেষ করার আশ্চর্য গুণ ছিল তার। ওই সময়ে আমি জহিরের বেশ কিছু কবিতাও পড়েছি। তার কবিতার দুই অঙ্গ, উজ্জ্বল চিত্রকল্পের আয়োজন ও উপস্থাপনার নিজস্ব ভঙ্গি। তার কবিতার বিষয় ও বক্তব্যের ধরনও সমকালীন অন্য কবিদের থেকে পুরোপুরি আলাদা। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে

রোজ রাতে একটি কলম ঠোঁট ঘষে তোমার খাতায়। 

চুমুর চিহ্নেরা আঁধারে সাঁতার কেটে কেটে ঘুম ভাঙায় শিল্পের।

(কবিতা: শিল্প, গ্রন্থ: মশলারাজ্য)

আমার বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, বাংলা কবিতায় এমন টাটকা সতেজ পঙ্ক্তি খুব একটা চোখে পড়ে না। আরও একটি উদাহরণ-

রাত বারোটায় মিনিটের কাঁটা বড়

অস্থির, কামান্ধ, 

উপগত হয় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা

ঘণ্টার কাঁটার ওপর, আঁতুড়ঘর কাঁপিয়ে তখন

কাঁদে নতুন দিবস।

(কবিতা: সময়, গ্রন্থ: জন্মান্ধ কৌরব) 

মেজাজে জহির অবশ্যই রোমান্টিক এবং বর্ণনায় রীতিমতো দক্ষ। চিত্ররূপময় প্রতীকী কবিতাতেও তার সমান মনোযোগ ও আগ্রহ।

কবিতা নিয়ে জহিরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই। একটি পুরো কবিতার বই ‘ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ’-এ কবি কোনো ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেননি। এই ব্যতিক্রমী কবিতাগুলো ২০১৫ সনের ১৬ আগস্ট থেকে শুরু করে ২০১৬-এর এপ্রিলের মধ্যে লেখা।

ক্রিয়াপদ এড়িয়ে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি সাজানো, কাব্যরসের স্বাদ বজায় রাখা, চিত্রকল্পের সফল প্রয়োগ, উপলব্ধির দুয়ার খুলে দিয়ে পাঠককে স্বাধীনভাবে ভাবতে সুযোগ করে দেওয়া, তার ওপর কবিতার প্রবহমানতা ধরে রেখে নানান রঙ আর ছবি আঁকা সত্যিই চাট্টিখানি কথা নয়। সেই জটিল ও অসম্ভব কাজ অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে করে দেখিয়েছেন কাজী জহিরুল ইসলাম। 

মধ্যপঞ্চাশে উপনীত এই কবির এ পর্যন্ত ২৬টি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। প্রতিটি কবিতার বইয়ে তিনি কল্পনাশক্তির নিখুঁত আয়োজনের মধ্য দিয়ে বস্তুর অন্তর্নিহিত রূপ প্রকাশে বেশ মনোযোগী হয়েছেন। বলা যায়, এটাই তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যে কোনো পাঠকের পক্ষে সহজ হয়, তার কবিতার অন্তর্গত সৌন্দর্যের গভীর থেকে আরও গভীরে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া। একজন কাজী জহিরুল ইসলাম সত্যই বিরল গুণের অধিকারী এবং এটা তিনি প্রকৃতিগতভাবেই রপ্ত করেছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //