রাবিয়া আল-বসরির কবিতা

ভারতীয় উপমহাদেশে রাবেয়া আল আদাবিয়া-রাবিয়া বসরি হিসেবে পরিচিত। তার জীবন কিংবদন্তিতে ভরা। সুফি রাবিয়া আল-আদাবিয়া একজন কবিও ছিলেন। তার অনেক কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। আরব বিশ্বে দুই নারী সুফি খুব চর্চিত। এদের একজন রাবিয়া আল বসরি বা রাবিয়া আল-আদাবিয়া, অন্যজন আয়েশা বায়ুনিয়া। দুজনই খুবই খ্যতিমান নারী কবি।

এক হাতে আগুন আর অন্য হাতে পানি নিয়ে দৌড়ে রাবিয়া একদিন বলেন, “আমি জান্নাত জ্বালিয়ে জাহান্নামের আগুন নিভিয়ে দেব যাতে আশেকানদের কাছ থেকে উভয় পর্দা উঠে যায়। আর তারা উদ্দেশ্যের প্রতি আন্তরিক হয়ে ওঠে। আল্লাহ্বান্দারা পুরস্কারের আশা বা শাস্তির ভয় ছাড়াই তাকে দেখতে শিখবে। এখন যেমন,  পুরস্কারের আশা বা শাস্তির ভয় কেড়ে নিলে কেউ মানবে না।”

এটাই ছিল বিখ্যাত মহিলা সুফি সাধক রাবিয়া আল-আদাবিয়ার মানসিকতা, যিনি ঐশ্বরিক প্রেমের মতবাদকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন আল্লাহ্প্রশংসা কেবল জিহ্বা, কান, চোখ, হাত বা পা দিয়ে করা নয়-করতে হয় জাগ্রত হৃদয় দিয়ে। রাবিয়া ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে বসরার একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার পিতা-মাতার চতুর্থ কন্যা ছিলেন। পরে তিনি এতিম হয়ে পড়েন। এরপর তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়।

ফরিদ-আল-দীন আত্তারের মতে, রাবিয়া তার মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে মাটিতে মুখ বুলিয়ে বলেন, “আমি শুধু চাই তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকো, তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট কি না তা জানতে চাই।” তিনি একটি উত্তর শুনেছেন যা তাকে দুঃখ না পাওয়ার জন্য আশ্বস্ত করে। আর তার ভালোর প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে রাবিয়া তার মালিকের কাছে ফিরে যান।

এক রাতে, যখন তিনি আল্লাহ্‌র কাছে সেজদারত, তখন তার মালিক তার কথা শুনছিলেন। তার মাথার ওপরে একটি রশিবিহীন লণ্ঠন ঝুলিয়ে পুরো ঘরটি আলোকিত করতে দেখেছিলেন। এই দেখে মালিক রাবিয়াকে মুক্ত করে দেন। রাবিয়া তার জীবন আল্লাহ্ক্ততে পার করেছেন। আত্তারের ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে রাবিয়ার জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। বসরার রাবিয়াকে একজন সুফি ওস্তাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হাস্যকরভাবে  তার সময়ে  লোকেরা সুফিসাধক “পুরুষদের প্রযোজ্য পদ” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। আসল কথা হচ্ছে-আল্লাহ্ একত্বতার প্রতি গভীর সুফি ধারণা ব্যক্তি, লিঙ্গ বা অবস্থার জন্য কোনো স্থান রাখে না।

রাবিয়ার আন্তরিকতা ও ভালোবাসার ফলে তিনি তার সময়ের পুরুষদের দ্বারা স্বীকৃত হন। তিনি আল্লাহ্ম্বন্ধে তাদের কাছে প্রজ্ঞার আবেগপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছিলেন। লোকেরা তার শিক্ষাগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। 

তিনি নিজেকে “দুর্বল মহিলা” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তার উপাধি তার কর্মের বিপরীত ছিল। কারণ তিনি একজন দৃঢ়চেতা মহিলা ছিলেন। তিনি তার সময়ের অন্যান্য সুফি ওস্তাদের সমালোচনা ও বিকাশে সাহায্য করেছিলেন। রাবিয়া একজন তপস্বীর জীবন যাপন করতেন।  তার একমাত্র চিন্তা ছিল একক খোদা। তিনি পরবর্তী মহিলা সাধকদের জন্য পথ প্রশস্ত করেছিলেন।

মূলত তিনি এমন একটি অবস্থায় পৌঁছেছিলেন যেটির জন্য সব সুফি তাদের নফস বা অহম ধ্বংসের মাধ্যমে চেষ্টা করে। তিনি প্রেম ও তাওয়াক্কুলের (বিশ্বাস) ওপর নির্মিত আল্লাহ্সাথে একটি সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষা বা জ্বলনের ভয়ে তার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেননি; বরং  তিনি কেবল আল্লাহ্‌কে খুশি করতে চেয়েছিলেন কখনো বিচ্ছিন্ন না হয়ে। রাবিয়া প্রার্থনার জন্য নির্জন জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তার জীবনের বেশিরভাগ সময় মরুভূমিতে নির্জনে কেটেছে।

রাবিয়া ও হাসান বসরি : হাসান আল-বসরিও একজন বিখ্যাত অতীন্দ্রিয়বাদী। হাসান ও রাবিয়াকে নিয়ে অনেক গল্প আছে। একদিন রাবিয়া তার কুঁড়েঘরের ভেতরে বসে আছেন। ভোর হয়ে গেছে। হাসান তাকে দেখতে আসেন। তখন সূর্য উঠছে আর পাখিরা গান করছে, গাছগুলো নাচছে। এটা সত্যিই একটা সুন্দর সকাল ছিল।

হাসান বাইরে থেকে ডাকে, “রাবিয়া, ভেতরে কী করছ? বাইরে আস! আল্লাহ এত সুন্দর সকালের জন্ম দিয়েছেন। ভেতরে কী করছ?” রাবিয়া হাসতে হাসতে বলেন, “হাসান, বাইরে শুধুই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, ভিতরে আল্লাহ নিজেই। তুমি ভিতরে আসো না কেন? হ্যাঁ, সকালটি সুন্দর, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সাথে তুলনা করা যায় না, যিনি সমস্ত সকাল সৃষ্টি করেন। হ্যাঁ, সেই পাখিরা সুন্দর করে গাইছে, কিন্তু আল্লাহ্গানের সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না। এটি তখনই ঘটে যখন তুমি ভেতরে থাক। তুমি ভেতরে আসো না কেন?” এ ধরনের গল্প ছোট, কিন্তু অসাধারণ ও তাৎপর্যময়।

সুফি অতীন্দ্রিয়বাদ: মধ্যযুগ এমন একটি সময় ছিল যখন মধ্যপ্রাচ্যের মহান ধর্মগুলি: ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান ও ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত দেশগুলিতে রহস্যবাদের বিস্তার ঘটেছিল। এই রহস্যবাদীদের মধ্যে কেউ কেউ যদি আধুনিক সময়ে বাস করতেন তবে তারা পাগল বলে বিবেচিত হতেন। যেসব প্রকৃত সালেকিন বা অন্বেষণকারী ছিলেন, তাদের মধ্যে রাবিয়া আল-আদাবিয়া বা রাবিয়া আল-বসরি অন্যতম।

সুফিদের একটি প্রধান বিশ্বাস ছিল যে, জাহান্নামের ভয়ে বা জান্নাতের আশায় আল্লাহর ইবাদত করা উচিত নয়।  বরং আল্লাহ্প্রতি ভালোবাসা নিজের মধ্যেই শেষ হওয়া উচিত। রাবিয়া একজন প্রতিভাবান গায়ক ছিলেন। গান গেয়ে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন তা দিয়ে তিনি ভালোভাবে বেঁচে ছিলেন। তার বয়স যখন ছত্রিশের কাছাকাছি।  বিয়ের অনুষ্ঠানের তিনি গান করছিলেন। হঠাৎ তার ভেতরের গানটা বদলে গেল।

বিয়ের অতিথিদের কাছে গান না করে তিনি নিজেকে আল্লাহর জন্য গান গাইতে থাকেন। তার সম্পর্কে বর্ণিত অনেক কিংবদন্তির সত্যতা যা-ই হোক না কেন, রাবিয়া যে একজন শক্তিশালী বিশ্বাসী মহিলা ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রভাব তার জীবদ্দশায় অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল। সুফিরা সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে একটি প্রভাবশালী সম্প্রদায় হিসেবে ছিলেন। 

সেই প্রভাব আজও বিদ্যমান। জীবনের কিছু অবশিষ্ট বিবরণ থেকে এটা প্রতীয়মান হয়-রাবিয়া কোনো এক সময়ে বাগদাদ ছেড়ে বসরায় বসতি স্থাপন করেন। তিনি সেখানে বহু বছর বসবাস করেন। তারপর মুসলিম বিশ্বের আরেকটি পবিত্র শহর জেরুজালেমে যান। তিনি মারা গেলে সেখানে তাকে সমাহিত করা হয়। এখানে রাবিয়া আল-বসরির ৫টি কবিতা পেশ করা হলো, যেগুলো অনেক বেশি তাৎপর্যময়।

একাকিত্ব ও প্রশান্তি

একাকিত্বে শান্তি জেনো ভাইয়েরা আমার,
প্রেমিক আমার একা থাকে আমার সাথে।
তেমন মেছাল পাইনি খুঁজে দিনদুনিয়ায়,
ভালোবাসার সাথে যা তার মিলতে পারে।

এমন প্রেমে ডুব দিয়েছি মরুভূমির বালির ভেতর,
পথ হারালেও পথ খুঁজে নিই প্রেমের আলোয়।

আমি যদি ইচ্ছে করে তার জন্যে যাই মরে যাই;
এতেও যদি আমার প্রেমিক খুশি না হয়-
তখন আমি হতাশাতে ডুবেই যাব।

অভিসারে হাতটি যদি শক্ত করে চেপেই ধরো,
তবু জানি সেজন আমার কোনোকালে ছাড়বে না যে!

একটা জানা, এই জানাটা তিনসত্যি-
সে যে আমার অনেক অনেক ভালোবাসে,
এটাই আমার দিনশেষে যে জানাশোনা।

দারোয়ান

আমি হলাম এক যে দারোয়ান,
আমার ভেতর যা আছে, তা দিই না বেরোতে।
বাইরে আছে যা কিছু মোর, দিই না ঢুকতে।
দারোয়ানের চাকরি দেবে? আমার জুড়ি নাই!

আমি হলাম সেই দারোয়ান অনেক অনেক গুণী
বেহুদা কেউ ঢুকলে পরে বেরোয় তরুণী
আমার সাথে কারুর তেমন নেই যে যোগাযোগ
আমি হলাম হৃদয় দারোয়ান,
ভেবো নাকো আমি কারো খোঁপার কোনো ফুল!

দুটি পথ

তোমাকে তো ভালোবাসার আছে দুটি পথ-
একটা হলো নিজস্ব সে স্বার্থপরতার,
অন্য যে পথ সেটা জানি তোমার বরাবর।
প্রথম পথটি ধরে আমি ভালোবাসি তোমার,
এ পথ জানি শুধু আমার অন্য কারো নয়।
অন্য কারো আশেকানায় পর্দা সরে গেলে
পলকবিহীন তোমার পানে থাকব চেয়ে থির।

প্রত্যাশা

একহাতে এই দেখ দেখি বহন করছি আগুন
অন্যহাতে বালতি ভরা ঠান্ডা শীতল পানি
ইচ্ছে আমার বেহেশতটা জ্বালিয়ে দিই,
বালতি ভরা পানি দিয়ে দোজখটাকে নিভিয়ে দিই।
খোদার যত আশেক আছে ছিঁড়ুক দেখি পর্দা সকল,
খোদার দিদার পাওয়াই তো যে লক্ষ্য আসল!

হায় খোদা

হায় খোদা মোর! তাকিয়ে দেখ-
যায় চলে যায় আরো একটি রাত,
আবার একটা উঠছে জেগে দিন!

বলো দেখি প্রভু,
আমার রাত্রিটা কি কাটিয়েছি ভালো?
এমন খবর জানলে পরে মনটা হবে স্বস্তিতে সুস্থির। 

সেটাই যদি সত্যি- তবে প্রশান্তি শতাধিক
যদিবা রাত্রিখানি নষ্ট করে থাকি, বলো তবু;
হারানো সেই রাতের তরে শোক করব আমি।

শপথ করছি, যেদিন আমার বন্ধু হয়েছ,
প্রথম দিবস থেকে আমার জীবন দিয়েছ।
আমি কিন্তু ঘুমিয়ে পড়িনি!

দরজা থেকে যদি আমায় দাও তাড়িয়ে তুমি,
দোহাই তোমার- আমরা দুজনে পৃথক হবো না কভু,
হৃদয়ে কেননা বেঁচে আছো তুমি প্রভু।
হায় খোদা! কী বলি তোমার,
আরো একটি কালো রাত যাচ্ছে চলে... 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //