গাফফার মাহমুদের কবিতা: যাপিত জীবনের শব্দশৈলী

সমকালের শ্রেষ্ঠ কবির লেখায় তার পূর্বসূরিরা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কেননা কোনো কবি বা শিল্পীই এককভাবে পরিপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করতে পারেন না। তার তাৎপর্য ও মূল্যায়ন হচ্ছে মৃত কবি এবং শিল্পীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের মূল্যায়ন। এককভাবে তার মূল্যায়ন করা যায় না।

সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিবেচনার জন্যে তাকে পূর্বসূরিদের সঙ্গে তুলনা করা প্রয়োজন। আর একজন কবির জন্যে অন্যের অনুভব হওয়া কিংবা অন্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা একপেশে কোনো ব্যাপার নয়; বরং নতুন শিল্পকর্ম নির্মাণের ফলে যা ঘটে তা আসলে এর পূর্ববর্তী সকল শিল্পকর্মের জন্যেই যুগপৎভাবে ঘটে। অতীতের স্মৃতি রক্ষার জন্যে যেসব শিল্পকর্ম বিদ্যমান আছে তাদের মধ্যে নতুন কোনো শিল্পকর্ম অন্তর্ভুক্ত হলে সে শৃঙ্খলায় নতুন অর্থ যুক্ত হয় । সেজন্য কবিতায় বা শিল্পকর্মে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেতুবন্ধ নির্মাণের প্রয়োজন হয়।কবিতায় ঐতিহ্যের রূপায়ণ বলতে অতীতের বা অব্যবহিত আগের প্রজন্মের যাবতীয় সাফল্যের অন্ধ বা ভীরু অনুসরণ বোঝায় না। বরং সেইসব উপাদানের পুনর্নির্মাণ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘Tradition and Individual Talent’প্রবন্ধে টি.এস. এলিয়ট বলেন: ...and novelty is better than repetition. Tradition is a matter of much wider significance. It cannot be inherited, and if you want it you must obtain it by great labor. It involves, in the first place, the historical sense.

ঐতিহ্যের সাথে ইতিহাসচেতনার সম্পর্ক গভীর। ইতিহাসচেতনার তাৎপর্য হলো বিনাশশীল কাল ও অবিনাশী ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান। অতীত কখনোই নিজের যুগের কৃর্তিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হতে দেয় না। বর্তমানের অন্তরে সে ফণ্ডুধারার মতো প্রবাহিত হয়, বর্তমানের অন্তরালে সে প্রেতের মতো বিরাজ করে, ভবিষ্যতের গর্ভে সে ভ্রুণের মতো পুনর্জাত হয়। ‘হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে, কাজ করে যাও গোপনে গোপনে’- অতীতের এই অবিনাশী অস্তিত্বকেই বলে ঐতিহ্য। ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ও পরিপূর্ণ বোধকে সংহত আকারে বলা যায় ইতিহাস চেতনা।  এই ইতিহাসচেতনার সঙ্গে জড়িত থাকে এক ধরনের উপলব্ধি যা শুধু অতীতের অতীত কালীনতারই নয়, বর্তমানেরও। যে কবি ইতিহাসচেতনায় উদ্বুদ্ধ তিনি তার অস্থিমজ্জায় শুধুমাত্র তার নিজের প্রজন্মকে লালন করেই লেখেন না; তিনি দূর ও নিকট অতীতের, দেশের ও বাইরের, সাহিত্য সম্পদকে ধারণ করে লেখেন। এই ইতিহাস চেতনাই একজন কবি বা লেখককে ঐতিহ্যবাদী করে তোলে। আর সেই কবিকে তার সময়গত অবস্থান ও তার নিজস্ব সমসাময়িকতা সম্পর্কে প্রবলভাবে সচেতন করে তোলে। এ প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের মন্তব্য স্মরণীয়: “কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিছন্ন কালজ্ঞান। কাল বা সময় বৈনাশিক; কিন্তু সে সেই সমস্ত কুয়াশাগুলোকেই কেটে-কেটে চলেছে যা পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপ্তি বাড়াবার পক্ষে অন্তরায়ের মতো। এই সমস্ত চেতনা নিয়েই মানবতার ও কবি মানবের ঐতিহ্য। কিন্তু এই ঐতিহ্যকে সাহিত্যে বা কবিতায় রূপায়িত করতে হলে ভাব-প্রতিভার প্রয়োজন বা প্রজ্ঞাকে স্বীকার করে নিয়ে নানা রকম ছন্দে অভিব্যক্ত হয়।’’ তবে কবিতায় ঐতিহ্যের অনুশীলনের বিষয়টি সবসময় লেখকের সৃজনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সৃজনশীলতার তার নিয়ামক ও মাপকাঠি; সঙ্গে যুক্ত থাকে তার ইতিহাসবোধ।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে শক্তি আহরণ করে একজন শিল্পীকে পথ চলতে হয়। কারণ ঐতিহ্য হচ্ছে আধুনিক শিল্পের অন্যতম প্রাণসম্পদ। কবিতায় কখনো তা রহস্যময় সংকেতের মতো শোনায়, আবার কখনো কখনো সমকালীন জীবনস্পন্দনের অঙ্গীকারে বিজ্ঞান অপেক্ষা সত্য হয়ে ওঠে। শিল্পীর কাছে তা শুধুমাত্র একটা তত্ত্ব হয়ে থাকে না, জীবন্ত শক্তিমত্তার উদ্দাম প্রেরণাস্থলরূপে বিরাজমান।  কবিতার বিষয়, প্রকরণ, ভাষা ও জীবনবোধ, সবদিক থেকেই একজন কবি ঐতিহ্যের মধ্যে গভীরভাবে নিহিতআধুনিক কবিতার সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সম্পর্ক বৃক্ষমূলের সাথে শেকড়ের আত্মীয়তার মতোই। ঐতিহ্যের সাথে কবিতার সম্পর্ক নির্ণয় আধুনিক কাব্যতত্ত্বের একটা প্রধান বিষয় এবং এর জন্যে অনেকটা পরিমাণে দায়ী এলিয়টের কবিতা ও তাঁর কাব্যসমালোচনা। আধুনিক বাংলা কাব্যে তাঁর প্রভাব সুগভীর ও সুদূর সঞ্চারী। মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে নজরুল হয়ে তিরিশের দশকে এসে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ হয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষভাবে এলিয়ট ও ডব্লিউ.বি. ইয়েটসের প্রভাব এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, জসীমউদ্দীন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল প্রমুখ কবি ঐতিহ্যের আত্মীকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। চল্লিশের দশকে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান একই পথে এই ধারায় প্রবহমান। কেননা ঐতিহ্য মানুষের রক্ত-মাংস-মজ্জার মতো বা অতীতের ধমনীর ভিতর দিয়ে এসে বর্তমানের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। পরবর্তীকালে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, মাহফুজ উল্লাহ, ওমর আলী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ফরহাদ মজহার, আবদুল মান্নান সৈয়দ, খন্দকার আশারাফ হোসেন প্রমুখ এই ধারাকে বহন করে নিয়ে যান অনেক দূর পর্যন্ত। সেজন্যে অনায়াসে বলা যায়, কোনো জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত ব্যক্তিচিত্তে তার জাতীয় ঐতিহ্যের উপস্থিতি অপ্রতিরোধ্য।


গাফফার মাহমুদ এই সময়ের একজন কবি। তাঁর কাব্যে নাগরিক জীবনস্পন্দন,সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমকালীন জীবনবোধের ধ্বনি প্রকাশিত। ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘আ ল্যাম্পপোস্ট বিদ্যাসাগর মশাই’ ও ‘ইউক্যালিপটাস শাখে নাগরিক কাক’ দুটি কাব্যগ্রন্থে কবির মনোভাব, সংবেদ, সংবেদনা, বহুস্তরীয় কল্পলোক, স্মৃতি-নস্টালজিয়া, জীবনানন্দ-বেদনা কাব্যভাষায় বিন্যস্ত।ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইউরোপের রেনেসাঁর প্রভাবে জীবনদর্শন ও সাহিত্যাদর্শে উচ্চকিত কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ উরিশ শতকে যে নতুন ধারার সাহিত্যসৃষ্টির সূচনা করে তারই চূড়ান্ত পরিণতি তিরিশোত্তর কালের সাহিত্যে প্রতিফলিত। এ-সময়ের সাহিত্য বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন দত্ত পরিচালিত ‘আধুনিকতাবাদী’ সাহিত্যাদর্শে উজ্জীবিত হয় ও প্রতিষ্ঠা পায় একচেটিয়াভাবে। এই প্রবাহের বিপরীতে পূর্ব বাংলার জীবন ও প্রকৃতির ক্যানভাসে জসীমউদ্দীন একটি স্বতন্ত্র ধারার রঙরূপরেখা অঙ্কনে সফলতা অর্জন করেন। তবে এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্যে সেই তিরিশোত্তর ধারার প্রাধান্য লক্ষণীয়। কবিতায় এই প্রবণতা আরো প্রতিফলিত। গাফফার মাহমুদের কবিতাও কাব্য-প্রবণতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে কল্লোলবাহিত আধুনিক কবিতার উত্তরাধিকার বহন করেন। তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ সেই সুরের কারুকাজে সজ্জিত। 

নাগরিক জীবনস্পন্দনগাফফার মাহমুদের কবিতার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। যাপিত জীবনের স্তরে স্তরে চলমান অভিজ্ঞতার যে বুদবুদ ও অভিঘাত তাই কবিকে ভাবায়, আন্দোলিত করে ও সৃজনের স্রোতে পরিচালিত করে। নাগরিক সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা, হর্ষ-ক্লেদ, প্রতীক-চিত্রকল্প জীবনের অলিগতিতে ঢেউ খেলে যায়। এসবের মাঝে মানুষ শান্তির সোনার হরিণ খুঁজে ফেরে। কিন্তু পায় কি?  

ধূসরতার পথ ধরে হাঁটছি, ইউক্যালিপটাস গাছের শাখে নাগরিক কাক 

জনসমাগম ব্যস্ত সড়ক, ক্রমাগত হাঁটছে মানুষ এবং মোটর বাইক 

দুপুরজুড়ে বিষণ্ণ শ্রমিক তোলেন হাই কোথা গেলে মিলবে তুমুল শান্তি!

...মুষড়েপড়া জীবনানন্দ দাশ প্রচ্ছন্নতায় দু-দণ্ড শান্তিখোঁজেন বারোমাস 

যান্ত্রিক সভ্যতা, বেপথু নিকটজন ক্রমাগত ভুলতে বসেছেন আত্মিক বন্ধন

মানুষ বেপথু বলে, ইদানিং পথ ঘাটে দল গড়েছে জোটভুক্ত কুকুর।

[ইউক্যালিপটাস শাখে নাগরিক কাক]

হেরিটেজ পার্ক; তির্যক রোদপ্রেম বিকেলের খুনসুটি 

আকাশ ছুঁই-ছুঁই বৃষ্টিবৃক্ষ, রেইনট্রিশাখায় দলছুট কাক

দুলছে প্রেমিকার চুল, জনহীন পার্কবেঞ্চ

সুবল মিত্র বিকেলে আসবে করেও এলোনা আজ 

পার্কবেঞ্চিতে বসে উৎকণ্ঠায় ভাবছে সুকণ্ঠ মেয়েটি

অকল্যাণে ডেকে যাচ্ছে কাক; মেয়েটাই চলে যাক।

[ইন দ্য পার্ক; ক্লাউডিং ক্রো]

নাগরিক জীবনে ‘কাকের প্রতীক’ বাংলা কবিতায় প্রচলিত, বহুল ব্যবহৃত ও সরব। জীবনের কর্কশ, ক্ষুধার্ত, নোংরাসহ যাবতীয় নেতিবাচক রূপক-প্রতীকের ক্ষেত্রে কাকের উপস্থিতি কার্যকর। নাগরিক জীবনের আবহে ও প্রবাহে কাকের ডাক, উপস্থিতি ও বিস্তার যেন অমঙ্গল বয়ে আনে। কবি সেই প্রতীকই নতুন চেতনা ও ভাষায় অঙ্কন করেন। 

মানুষ বসবাস করে তার সংস্কৃতির মাঝে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালনের মাধ্যমে সে আসলে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে চায়। বর্তমান সময়ে সংস্কৃতি প্রশ্নটি বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির আছে। যে কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠীর পরিচয় পেতে সংস্কৃতির দারস্থ হতে হয়। হাজার বছরের উৎপাদন সম্পর্ক, রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক বা ভাষিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতির কাঠামো গড়ে ওঠে। সময়ের প্রয়োজনে তার বাঁকবদল ঘটে এবং রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। রাষ্ট্রকাঠামোর সাথে সংস্কৃতির আন্তঃযোগাযোগ গভীর ও বহুমুখী। ফলে সংস্কৃতির প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সমাজে-রাষ্ট্রে বিরাজ করে। কবি ব্যক্তি জীবনে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালনের বিষয়টি পিতার প্রতি আবেগ, অনুভূতি ও আত্মিক সম্পর্কে বিন্যস্ত করেন। একই সাথে বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পরস্পর প্রতিবেশী অবস্থান থেকে প্রকাশ করেন। 

পিতাকে দেখেছি রোজ আযান হলেই দাঁড়িয়ে যেতেন নামাজের খাটে 

কতো আন্তরিক কর্তব্যবান ছিলেন নামাজের প্রতি আমার প্রিয় পিতা 

ব্যস্ততা তার দৈনন্দিন কাজে, তবুও নামাজ পড়া চাই আগে 

প্রত্যূষে উঠে যেতেন; ফজরের আযান হতো ঘুম ভাঙার পর

... পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তার হাতে তসবীদানা, মোহগ্রস্ত আত্মমগ্নধ্যান 

প্রার্থনা ছিলো পিতার; মানুষের পারস্পরিক সুখ, মাঙ্গলিক পৃথিবী 

সম্পদ বলতে বুঝাতেন প্রিয় পুত্র-কন্যাগণ, রাতের আবাস চালাঘর 

কোন কষ্টই ছিলোনা তার; দৃঢ়তার ভিত ছিলো দেহান্ত বুকে

দূর মুয়াজ্জিনের আযান; পিছে পরে থাকতো পিতার সব কাজ।

[মুয়াজ্জিনের আযান, পিতার নামাজ]

নদী সন্ধ্যার কোল জুড়ে সুবর্ণপুর কৌরিখাড়া গ্রাম 

এই হেমন্তে নবান্ন উৎসবে জেগে উঠতো বিশ্বাসবাড়ি 

মাতোয়াল চাঁদ রাত, দল বেঁধে যেতাম হৈমন্তিপাড়া 

আমাদের সংগে থাকা নির্মাল্য কার্তিক গাইতো শিসগান।

প্রকৃতির বিষ্ঠায় ছেয়ে গেছে লাউফুল

নবান্ন উৎসবে দূর গা কাকশূন্যপুর

এবার কার্তিক পুজোয় দল বেঁধে যাবো হৈমন্তিপাড়া 

সমস্বরে গেয়ে উঠবো সুর, পাড়াতোভাই মিলে-

নীল অপরাজিতা ফুল, ফুটে আছে নারকেলপাতা জুড়ে 

আকাশে পুচ্ছপুচ্ছ সাদাসাদা মেঘ, নির্মাল্য কার্তিক আবেগ

অদূরে শঙ্খধ্বনি, পাড়া জুড়ে কোথাও নেই হৈমন্তি মেয়ে

হেমন্ত উৎসব, মৌনব্রত আছেন আমাদের নির্মাল্য কার্তিক!

[হৈমন্তিপাড়ায় নির্মাল্য কার্তিক]

আবহমান বাংলায় ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিরাজ করে আনন্দের সঙ্গে। পাশাপাশি দুটি ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থান, বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দের ইতিহাস আছে। বৈরিতাও কম নেই। তবুও সন্নিহিত দুটি সম্প্রদায়ের মেলবন্ধন ও হৃদতা অনেক সময় সাংস্কৃতিক সেতু নির্মাণ করে দেয়। কবি সেই মিশ্র সাংস্কৃতির মাঝে নিজের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি তুলে ধরেন নিজস্ব কাব্যভাষায়।    

নাগরিক বোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্মৃতি-নস্টালজিয়া, সমাজ সচেতনতার সাথে সাথে সমকালীন জীবনবোধের উৎসারণ লক্ষণীয়। পুঁজিবাদী নগর সভ্যতায় রাষ্ট্র প্রচণ্ড শক্তিশালী ও সর্বগ্রাসী প্রতিষ্ঠান। ফরাসি বিপ্লবী ও চিন্তাবিদ দার্শনিক ল্ইু আলথুসের ‘আইডিওলজি এন্ড আইডিওলজিক্যাল স্টেইট অ্যাপারেটাস’ গ্রন্থে দেখান- শ্রেণিসংগ্রামের লক্ষ্য যে রাষ্ট্রক্ষমতা তাকে টিকিয়ে রাখতে শাসকশ্রেণি নানা ধরনের ভাবাদর্শিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে থাকে। নিপীড়নমূলক বা দমনমূলক রাষ্ট্রীয় কলকব্জার সাথে ভাবাদর্শিক হাতিয়ার ব্যবহার করে শাসকশ্রেণি মতাদর্শিক ঐক্য স্থাপনে কাজ করে। অন্যদিকে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কও লক্ষণীয়। রাষ্ট্রের ভাবাদর্শিক হেজিমনি মোকাবিলা ও বিপরীত মতাদর্শিক হেজিমনি প্রতিষ্ঠার জন্য জনসমাজে দ্বান্দ্বিক তৎপরতা দৃশ্যমান। বিশেষভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে এ-ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে আছে। তবে একজন নাগরিক এই রাষ্ট্রের সীমানায় অসহায় ও শক্তিহীন অবস্থায় থাকে; যার মঙ্গলচেতনা ও উত্তরণের আশা ছাড়া কোন কিছু করার নাই।  

কি সব বিচ্ছিরী চারদিকে কদাকার 

নষ্ট, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা 

কতোগুলো শকুনি প্রতিদিন গিলছে 

দুর্বলদের উপার্জিত টাকা, মৃত মানুষের হাড়গোড়

বীভৎস, ক্লেদাক্ত পথ; কোথাও নেই সজীবতা 

আষ্টেপূঁজ চারিদিকে পচন; রাষ্ট্র গহ্বরে

যারাই ছিলো মুক্তবিহঙ্গ, বাকদীপ্ত প্রজ্ঞাবান 

রাষ্ট্র চেঁপেছে গলা; জেলে গেছেন তারা

...আসুন বন্ধুগণ,

পাকসাফ করি নষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্র

বোধহীন মানুষের গু

চোখে পিঁচুটি এঁটে আজ অন্ধ সেজেছে যারা।

[রাষ্ট্রযন্ত্র ধুয়ে ফেলি, আসুন বন্ধুগণ]

রক্ত মাংস আদলে দুই পায়ে দণ্ডায়মান 

অবিন্যাস্ত তুমিও রয়েছো আপাদমস্তক 

দুই হাতে তুড়ি দিয়ে সাজো নিষ্ঠাবান।

মুখোশের পরে মুখোশ আঁটো 

পারফিউম মেখে নিজেকে সাজাও 

সুদর্শন প্রিয় তুখোড় মানুষ।

দুধে জল মেশাতে তুমি কতোই পটু

নিজেই সদা আছো ঘেরে রাখ হাঁটু।

টাকাই তোমার আয়েশ 

আর সব কিছু মেকি 

তুমি যে আসলে মুখেই মানুষ।

অন্যকে ঠকিয়ে হাটে মারো গুল 

তোমার প্রতারণায় তুমি যে অতুল।

[মুখোশে অতুল]

মেকি নগর সভ্যতায় কবির দিনযাপনের অভিজ্ঞতাজাত যে ভাবনা, উপলব্ধি, বোধ, নেতিবাচক দৃষ্টি তা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন কবিতায়। কবি বসবাস করেন সমকালে, এই সমকালের যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা, বিষাদ-বেদনা ও প্রতারণা-প্রবঞ্চনায় আক্রান্ত হয়ে কবির মাঝে জন্ম নিয়েছে অসন্তোষ। নগর জীবনের প্রতি এই অসন্তোষ থেকেই কবি অতীতের জগতে, ঐতিহ্যে ও নস্টালজিয়ায়  ফিরে যেতে চান।  

মোহগ্রস্ত শব্দখেলায় মেতেছি সারা দিনমান 

বিস্তর পড়েছি প্রকৃতিপৃষ্ঠার পত্র বিহঙ্গলতা 

কতো হেঁটেছি অচেনা গ্রাম, ধুলোযুক্ত পথ।

লোভে মজিনি কখনো শঠতার ফাঁদে 

উদ্বাস্তু থেকেছি যা প্রকৃত করেছি ধারণ 

জীবন শকটে চলেছি সহজিয়া শব্দের দ্বৈরথ।

কী আর করেছি জমা, কবিতাভাবনা ছাড়া 

শব্দখেলার সুইজব্যাংকে মজুদ রেখেছি কথা 

আমি কবি; বিস্তর জমিয়েছি কবিতাসম্পদ।

[জীবনের প্রবাদ]

এইভাবে কবি জীবনযাপনের স্পন্দনে ও অনুভবে শব্দনির্মাণ করেন আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে। বর্তমানের নেতিবাচক সময় ও সমাজ থেকে মঙ্গলের দিকে ও জীবনের সত্যে কবি পৌঁছাতে চান। ফলে অতীতে, প্রকৃতিতে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে কবি আশ্রয় খুঁজেছেন। 

প্রকরণের দিক থেকে কবি সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন অনেকটাই। বিশেষভাবে শব্দ ব্যবহারে নিজস্ব ঢঙ লক্ষণীয়। কিছু কিছু কবিতায় ছন্দ ও মিলের প্রয়োগ উল্লেখযোগ্য। সেইসাথে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক-অনুপ্রাস ও প্রতীকের ব্যবহারে দক্ষতার চিহ্ন প্রকাশিত। সবমিলিয়ে একজন কবির আত্মপ্রকাশের স্বাক্ষর ও উচ্চারণ এই দুটি কাব্যে উপভোগ করা যায়। 


মানবিক শুভবোধ, নাগরিক জীবনের প্রতি অনীহা ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ মনোভাব ও কাব্যিক ভাষাশৈলী কবি গাফফার মাহমুদকে স্বতন্ত্র কবি হিসেবে পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়েছে। আঙ্গিকের দিক থেকে তিরিশের আধুনিকতাবাদী ধারার প্রবণতা তাঁর মাঝে কাজ করেছে। সবমিলিয়ে বলা যায় এই দুটি কাব্যগ্রন্থ কবিকে নিজস্ব পরিচয়ে উজ্জ্বল করবে আগামী দিনে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //