নুর-মামুনদের গ্রেফতারে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

সারা দেশে ধর্ষণের মামলায় আসামিদের গ্রেফতার করা হলেও, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুর ও তার সহযোগীদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না- তা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের নেতারা।

আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পদদেশে এক বিক্ষোভ-সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহবুব ধর্ষণে সহযোগিতার মামলায় নুর ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ যেখানে সমাবেশ করে তার পাশেই অনশন কর্মসূচিতে বসেছেন নুরদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী ঢাবি শিক্ষার্থী। মূলত ওই শিক্ষার্থীর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ আজ ক্যাম্পাসে পদযাত্রা ও সমাবেশ করে।

এ সময় নুর-মামুনদের গ্রেফতারে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা সনেট মাহবুব। তিনি আরো বলেন, ‘আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নুর-মামুনদের গ্রেফতার করা না হলে কঠোর আন্দোলন করা হবে।’ এছাড়া সারা দেশে বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনায় রাজনৈতিক রং দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনশনে বসেন ঢাবির ওই ছাত্রী। ছাত্রলীগের অন্তত ২০ জন নেতাকর্মী ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সেখানে অবস্থান নেন। এ ছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নেতাকর্মীও এর সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছেন।

ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন কুয়েত মৈত্রী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদা পারভীন, ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জেরিন তাসনি পূর্ণি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক তিলোত্তমা শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফারজানা নিপা, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হেসেন নিশি।

ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ এনে গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর লালবাগ থানায় একটি মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী। মামলার আসামিরা হলেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন (২৮), যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হাসান সোহাগ (২৮), ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর (২৫), ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম (২৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের সহসভাপতি নাজমুল হুদা (২৫) ও আব্দুল্লাহিল বাকি (২৩)। আদালত মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

পরের দিন একই আসামিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন একই বাদী। পরস্পর যোগসাজশে অপহরণ করে ধর্ষণ, ধর্ষণে সহায়তা এবং হেয়প্রতিপন্ন করে ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার করার অভিযোগ এনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করা হয়। কোতোয়ালি থানায় করা মামলায় নাজমুল হাসান সোহাগকে ১ নম্বর, হাসান আল মামুনকে ২ নম্বর ও নুরুল হক নুরকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়।

লালবাগ থানায় করা এজাহারে বাদী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী উল্লেখ করেন, ‘আসামি হাসান আল মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই এবং বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই মামুনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয় এবং পরে তা প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। এর ধারাবাহিকতায় আসামির সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময়ে মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কথোপকথন হয়। সেখানে আসামি আমাকে শারীরিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় আসামি এ বছরের ৩ জানুয়ারি দুপুর ২টার দিকে তার বাসা নবাবগঞ্জ বড় মসজিদ এলাকায় যেতে বলে এবং আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার বাসায় ধর্ষণ করে।’

এজাহারে আরো বলা হয়েছে, ‘ঘটনার পর গত ৪ জানুয়ারি আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ১২ জানুয়ারি আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মামুনের বন্ধু সোহাগের মাধ্যমে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় আমি ক্যাম্পাস রিপোর্টারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে মামুন ও সোহাগ বাধা দেয়। এর আগে মামুনকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে সে রাজি হয়, কিন্তু আমি অসুস্থ হওয়ার পর সে নানা টালবাহানা শুরু করে।’

উপায়ান্তর না দেখে গত ২০ জুন বিষয়টি ভিপি নুরকে মৌখিকভাবে জানাই উল্লেখ করে এজাহারে আরো বলা হয়, ‘নুর বলেন, মামুন আমার সহযোদ্ধা। তাঁর সঙ্গে বসে একটা সুব্যবস্থা করে দেব। এরপর ২৪ জুন মীমাংসার আশ্বাস দিয়ে তিনি আমার সঙ্গে নীলক্ষেতে দেখা করতে আসেন। কিন্তু মীমাংসার বিষয়টি এড়িয়ে আমাকে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। আমি যদি বাড়াবাড়ি করি, তাহলে তাঁর ভক্তদের দিয়ে ফেসবুকে আমার নামে উল্টাপাল্টা পোস্ট করাবে এবং আমাকে পতিতা বলে প্রচার করবে বলে হুমকি দেয়। তাদের ছাত্র অধিকার পরিষদের ১.১ মিলিয়ন সদস্যের গ্রুপে এ প্রচারণার হুমকি দেওয়া হয়। নুর আরো বলেন, তার একটি লাইভে আমার সব সম্মান চলে যাবে। ইতোমধ্যে মামলার চার নম্বর আসামি সাইফুল ইসলাম আমার নামে কুৎসা রটিয়েছে এবং ৫ ও ৬ নম্বর আসামিকে লাগিয়ে দেয় কুৎসা রটাতে। তারা মেসেঞ্জার চ্যাট গ্রুপে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করাসহ সম্মিলিতভাবে চক্রান্ত করে।’

এজাহারে বাদী আরো বলেন, ‘ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা পর্যায়ের কয়েকজন বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করতে চাইলেও আসামিরা তাদের ষড়যন্ত্রকারী বলে আখ্যা দেয়। এরপর আমি শারীরিক-মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে বলার কারণে মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে।’

লালবাগ থানায় করা এই মামলাকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে এর প্রতিবাদে গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মশাল মিছিল ও সমাবেশ করে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ। ওই বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। সমাবেশ শেষে নুরসহ তাঁর ছয় সহযোগীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর রাত ১০টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লে ডিবি পুলিশ প্রহরায় নুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ফের তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। অনেক নাটকীয়তার পর  রাত পৌনে ১টার দিকে নুরকে মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সময় নুরের সঙ্গে আটক তাঁর পাঁচ সহযোগীকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। সহযোগীদের কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর দায়ের করা মামলার আসামি নন। রাত ১টার দিকে নুরসহ ছয়জনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

ভিপি নুরুল হক নুরের দাবি, ‘আমরা যেহেতু সরকারের বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলি, তাই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ মামলা করা হয়েছে।’

মামলার পর প্রধান আসামি বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সংগঠনটির পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।

পরের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কিংবা নীলক্ষেত এলাকায় সিসি টিভির ফুটেজ রয়েছে। পাশে নিউমার্কেট থানা রয়েছে। তো, এই একটা তথ্য যদি প্রমাণ করতে পারেন, আমি নীলক্ষেতে ২৪ জুন ওই মেয়ের সঙ্গে দেখা করেছি বা বিষয়টি মীমাংসার ব্যাপারে কথা বলেছি, তাহলে আমি সমস্ত অভিযোগ মাথা পেতে নেব। রাজনীতি থেকে আমি সরে দাঁড়াব। এবং নিজেকে অপরাধী বলেই মনে করব ও আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের বলব।’

নুরুল হক নুর বলেন, ‘ওই মেয়েকে যারা চেনেন বা সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোক আছেন, তারা একটি বিষয় খালি প্রমাণ করুক যে, মেয়েটির সঙ্গে আমরা ২৪ তারিখ মীমাংসার জন্য নীলক্ষেতে বসেছি এবং সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। এবং সেখানে আমরা তাঁকে হুমকি দিয়েছি। এটা যদি প্রমাণ করতে পারেন, দ্যাটস এনাফ। আর কোনো কিছুর দরকার হবে না। আমি অপরাধ মাথা পেতে নেব।’

‘মেয়েটি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে, পুলিশ এজাহারভুক্ত করেছে। আমি জানি না পুলিশ আসলে কোন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটাকে এজাহারভুক্ত করল?’ বলে প্রশ্ন রাখেন ভিপি নুর।

নুরুল হক নুর আরো বলেন, ‘আমি তো জানি, আমি অপরাধী কিনা। এখনো সত্য কথা বলছি, যে নিজের বুকে জোর আছে। এই মেয়ের সঙ্গে আমার এই ধরনের কোনো কথা-বার্তা হয়নি এবং আমি তাঁকে হুমকিও দেইনি। আমি কোনো অপরাধ করিনি।’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : ভিপি নুর

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //