মওদুদের মরদেহ বৃহস্পতিবার দেশে আসবে

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদের মরদেহ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে দেশে আনা হবে।

দেশে এনে মরদেহ রাখা হবে ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমাগারে। পরদিন শুক্রবার জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মানিকপুর গ্রামে বাবা-মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে তাকে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান সাম্প্রতিক দেশকালকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, শুক্রবার (২০ মার্চ) জাতীয় সংসদে তার জানাজার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অনুমতি পেলে সেখানে প্রথম জানাজা হবে। এরপর দ্বিতীয় জানাজা হবে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। সেখান থেকে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে শেষ জানাজা হবে। তারপর মা-বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।

এর আগে মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) বাংলাদেশ সময় সাড়ে ৬টার দিকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে গেলে মওদুদকে গত ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাসের চিকিৎসা শেষে ২৯ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন এই রাজনীতিক। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ১ ফেব্রুয়ারি তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। এরপর ১০ মার্চ সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১৯৪০ সালের ২৪ মে  ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমদ এবং মা বেগম আম্বিয়া খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ তিনি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশি নির্যাতনের পর মওদুদ আহমদের ঠাঁই হয়েছিল কারাগারে। ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির নেতা ছিলেন।

পেশাজীবী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে নানা ভূমিকায় নিজেকে রেখেছিলেন রাজনীতির কক্ষপথেই। বিএনপি আর জাতীয় পার্টি গঠনে পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। কারাভোগ করেছেন পাকিস্তান আমল, বঙ্গবন্ধু, এরশাদ, ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট সরকারের আমলে।

শিক্ষাজীবনে মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাস করে ব্রিটেনের লন্ডনের লিঙ্কন্স্ ইন থেকে অর্জন করেন বার-অ্যাট-ল। দেশে ফিরে হাইকোর্টে ওকালতির একপর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন আইনি লড়াইয়ে।

বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করতে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসিকে বাংলাদেশে আনতে রেখেছিলেন ভূমিকা। ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান আহূত গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠকের ভূমিকা ছাড়াও ব্যারিস্টার মওদুদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল নিয়োগ করে মুজিবনগর সরকার। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকেও তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে।

নানা ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭৭ সালে মওদুদ আহমদ দায়িত্ব পান উপদেষ্টার। বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে গঠিত জাগদলের ১৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। পরে জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে বিএনপি গঠিত হলে সে কমিটির অন্যতম সদস্য হন মওদুদ।

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মওদুদ। কর্মসূচির বিরোধিতা করাসহ নানা কারণে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন জিয়া। কয়েকজন বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। অন্যদিকে দলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ৮৫ সালের ২৫ জুন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন মওদুদ আহমদ।

এরশাদ আমলের প্রথম দিকে তিনি ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই এরশাদ সরকারে যোগ দিয়ে মন্ত্রিত্ব পান। সেই সঙ্গে জাতীয় পার্টি গঠনে পালন করেন অন্যতম ভূমিকা।

১৯৮৫ সালে যোগাযোগমন্ত্রী, ৮৬ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী, ৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব পালন করেন মওদুদ। ৮৯ সালে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ পান। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে কিছু সময়ের জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন এবং পরবর্তী অস্থায়ী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালে মওদুদ আহমদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের ভারপ্রাপ্ত নেতার দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিদর্লীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাঁচবার মওদুদ আহমদ নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে নির্বাচিত হন। তারপর থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মওদুদ আহমদ রচনা করেছেন এক ডজনের বেশি বই। যার মধ্যে রয়েছে- ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ : এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি’, ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ’, ‘সাউথ এশিয়া: ক্রাইসিস অব ডেভেলপমেন্ট দি কেস অব বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ : এ স্টাডি অব দ্যা ডেমোক্রেটিক রেজিম’ ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ১৯৯১ থেকে ২০০৬’, ‘চলমান ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা’, ‘কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮’, ‘সংসদে যা বলেছি’, ও ‘ইন লাভিং মেমোরি অব আমান মওদুদ, হিজ লাইফ অ্যান্ড আর্ট’।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //