বিএনপির সমাবেশ ঠেকাতে এত আয়োজন কেন?

গত ২২ অক্টোবর খুলনায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে গণপরিবহন খাতে যে ঘটনা ঘটলো বা ঘটানো হলো, সেটি অভূতপূর্ব। এই সমাবেশ ব্যর্থ করতে গিয়ে পরিবহন খাতের লোকেরা যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাতে এটা না বোঝার কোনো উপায় নেই, তারা কাজটি আদিষ্ট হয়ে করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন।

এই ঘটনায় মূলধারার গণমাধ্যমে গণপরিবহনজনিত সংকটে জনদুর্ভোগের বিষয়টি অধিকতর আলোচিত হলেও এর অন্তর্নিহিত রাজনীতি নিয়ে খুব বেশি বিশ্লেষণ নেই কিংবা এই বিষয়ে খুব গভীর কোনো বিশ্লেষণ প্রকাশ ও প্রচারের মতো বাস্তবতাও রয়েছে কিনা, সেটিও বিরাট প্রশ্ন।

খুলনায় বিএনপির এই সমাবেশের আগে দেশের মূলধারার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে চোখ বোলানো যাক-

১. খুলনায় বিএনপির সমাবেশের আগের দিন থেকে বাস চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত: প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর।

২. বিএনপির সমাবেশ ঘিরে খুলনায় এবার ৪৮ ঘণ্টা লঞ্চ বন্ধ: ডেইলি স্টার অনলাইন, ২১ অক্টোবর।

৩. সাতক্ষীরা-খুলনা গণপরিবহন চলাচল বন্ধ, ভোগান্তিতে মানুষ: সময় টিভি অনলাইন, ২২ অক্টোবর।

৪. খুলনায় বিএনপির সমাবেশ আজ, গণপরিবহন বন্ধ, পথে পথে দুর্ভোগ: কালের কণ্ঠ, ২২ অক্টোবর।

৫. খুলনায় বাস-লঞ্চ চলাচল বন্ধের দ্বিতীয় দিনে ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ; সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরীক্ষা দিতে পারেননি দুই-তৃতীয়াংশ: ইউএনবি, ২২ অক্টোবর।

কেন গণপরিবহন বন্ধ করা হলো, তা এসব সংবাদ শিরোনামে স্পষ্ট। কারা বন্ধ করেছেন, সেটিও অজানা নয়। যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেছেন, বাসমালিকরা কেন খুলনার বাস বন্ধ রেখেছেন, সে বিষয়ে তারা আমাদের অফিশিয়ালি কিছু জানাননি। কোনো দাবি- দাওয়াও উপস্থাপন করা হয়নি। আমরা এ ব্যাপারে জানি না। পরিবহন মালিকরা আমাদের বলে ধর্মঘট করেন না। তবে এ ধরনের কোনো বিষয় যখন আমাদের নজরে আসে, আমরা ব্যবস্থা নিই। (প্রথম আলো, ২১ অক্টোবর ২০২২)

বিএনপির কর্মসূচির কারণে গণপরিবহন বন্ধের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, পরিবহন মালিকরা বিএনপির সমাবেশের কথা শুনলেই এখন ভয় পান। তারা জানমালের ক্ষতির ভয় পাচ্ছেন। সে কারণে পরিবহন বন্ধ করেছে। (বাংলা ট্রিবিউন, ২২ অক্টোবর ২০২২)

অন্যদিকে খুলনা মোটর বাস মালিক সমিতির সভাপতি ও মালিক- শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল গাফফার বিশ্বাস ৭১ টেলিভিশনে বলেছেন, এই ধর্মঘটের সঙ্গে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সম্পৃক্ত নয়। আওয়ামী লীগপন্থি কিছু লোক ধর্মঘট ডেকেছেন। তিনি দাবি করেন, বাস না চালানোর বিষযে তাদের ওপর চাপ ছিল। তারা কেন পুলিশের সহায়তা নিলেন না- সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে গাফফার বিশ্বাস বলেন, আপনি তো জানেন দেশের অবস্থা কী।

এ সময় অনুষ্ঠানের অন্য অতিথি সিনিয়র সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান ওই পরিবহন নেতাকে প্রশ্ন করেন, মুষ্টিমেয় কিছু লোক ধর্মঘট ডেকে গণপরিবহন বন্ধ করে দিল। আপনারা সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন বাস চালালেন না? তখন গাফফার বিশ্বাস একই সুরে বলেন, বাস চালাতে গেলে সংঘর্ষ হতো। তা ছাড়া দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এখন প্রশ্ন হলো- যে সমাবেশ ব্যর্থ করার জন্য এত আয়োজন, সেটি শেষ পর্যন্ত কি ব্যর্থ হয়েছে? গণমাধ্যমের খবর বলছে, দুই দিনের পরিবহন ধর্মঘট থাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিকল্প পরিবহনে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। বাধা ডিঙিয়ে দলে দলে বিএনপির সমাবেশে যোগ দেন নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। এ বিষয়ে পরদিন দেশের প্রধান কয়েকটি সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণের সংবাদ শিরোনাম-

১. বাধা ঠেলে বড় জমায়েত খুলনায়: প্রথম আলো।

২. বাধা পেরিয়ে খুলনায় জনস্রোত; নিরাপদে সরে যান, না হলে গণঅভ্যুত্থানে পতন হবে: যুগান্তর।

৩. ‘বিচ্ছিন্ন খুলনা’ যেন বিএনপির মিছিলের নগরী: সমকাল।

৪. বাধা পেরিয়ে লোকারণ্য খুলনা: মানবজমিন।

তার মানে গণপরিবহন বন্ধ করেও সমাবেশটি পুরোপুরি ব্যর্থ করা যায়নি। বরং এর মধ্য দিয়ে বিএনপির কয়েকটি লাভ হয়েছে। যেমন-

এত বাধা ডিঙিয়ে যারা সমাবেশে যোগ দিয়েছেন, তারা দলের কাছে পরীক্ষিত নেতাকর্মীতে পরিণত হয়েছেন। ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে তারা এর প্রতিদান পাবেন।  

সরকার বলছে যে, গণপরিবহন বন্ধের বিষয়ে তাদের কোনো হাত নেই। এটা পরিবহন সংশ্লিষ্টরা করেছেন। এই কথার ভেতরে কতটুকু সত্যতা আছে, সেটি একজন অতিসাধারণ মানুষও বোঝেন। তার মানে, গণপরিবহন বন্ধের ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগের জন্য সাধারণ মানুষ প্রকারান্তরে সরকার ও সরকারি দলকে দায়ী করছে, যেটি মাঠের রাজনীতিতে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির পয়েন্ট বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে। প্রশ্ন হলো- সরকার বা সরকারি দল এমন কাজ কেন করতে গেল, যার মধ্য দিয়ে তার নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরি হয়?

যে কারণে হাতেগোনা দুই- একটি সংবাদমাধ্যম বাদে কেউই, বিশেষ করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিএনপি ও তাদের শরিক বা সমমনা দলগুলোর কর্মসূচি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে না কিংবা করতে পারে নাই; কিন্তু যখনই বিএনপির সমাবেশ ব্যর্থ করার জন্য গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হলো, তখন বিএনপি সব গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়ে উঠল।

যে বিএনপি অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিল যে, গণমাধ্যমে তাদের কর্মসূচির খবর ঠিকমতো আসে না বা বড় আকারে প্রকাশ ও প্রচার হয় না, সেই বিএনপিকে প্রধান শিরোনামে নিয়ে এলো গণপরিবহন বন্ধের ঘটনা। কেউ কেউ রসিকতা করে বলেন, পরিবহন সংশ্লিষ্টরাই বিএনপির সমাবেশ সফল করে দিলেন, তাতে তাদের এই পদক্ষেপের পেছনে যাদের ভূমিকাই থাকুক।

ধরা যাক বিএনপির একটি মিছিল রাজধানীর পল্টন এলাকা প্রদক্ষিণ করল। সরকারি দলের নেতাকর্মী বা পুলিশ তাতে কোনো বাধা দিল না। এই মিছিলের সংবাদটি ওইদিন টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল বা দৈনিক পত্রিকায় খুব একটা গুরুত্ব পাবে না; কিন্তু যদি ওই মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ বা সরকারি দলের নেতাকর্মীরা হামলা করে তখন সংবাদটি বড় হয়ে যাবে। পরদিন ছাপা পত্রিকায়ও খবরটি আসবে প্রথম পৃষ্ঠায়। তাতে লাভ হলো কার, সরকারের না বিরোধীদের? সরকার বা সরকারি দলের লোকেরা কেন এমন পদক্ষেপ নেয়, যা বিরোধীদের প্রতি জনসমর্থন ও সহানুভূতি বাড়াতে ভূমিকা রাখে?

আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, যারা বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা কেন বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল, যাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর সখ্য সর্বজনবিদিত- সেই দলটিকে মোকাবিলা করতে এমন কৌশল কেন নিচ্ছে, যার ফলে বিএনপিই লাভবান হচ্ছে? স্মরণ করা যেতে পারে, সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেয়া না হয়।

এমনকি গণভবন ঘেরাও করতে এলে বিএনপি নেতাদের তিনি চা খাওয়াবেন বলেও মন্তব্য করেছিলেন; কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন ঘটলো যে, বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে? বিএনপি যদি তার মতো সারা দেশে সমাবেশ করে তাতে কি সরকারের পতন হয়ে যাবে? 

এখন যেহেতু সারা বিশ্বের অর্থনীতিই একটা চাপের মধ্যে রয়েছে; যেহেতু গ্যাস সংকটের কারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না বলে ভয়াবহ লোডশেডিং হচ্ছে, এমনকি স্বয়ং জ্বালানি উপদেষ্টাও নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন।

যেখানে আগামী বছর বিশ্বের নানা প্রান্তের মতো বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্য সংকট তৈরির আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীও; সেখানে এসব সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার বিপরীতে বিএনপির সমাবেশকে এত বেশি পাত্তা দিয়ে; তাদের সমাবেশ ব্যর্থ করতে সব গণপরিবহন বন্ধ করে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ঠেলে দিয়ে সরকার কি নিজের এলোমেলো অবস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, নাকি সরকারের ভেতরের লোকজনই এই দুঃসময়ে সরকারকে তথা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে বিপদে ফেলতে স্যাবোটাজ করছে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //