জামায়াতের বিকল্প বিডিপি!

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে সম্প্রতি যে দলটি নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছে, এর সঙ্গে নিবন্ধন বাতিল হওয়া স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও জামায়াত কিংবা নতুন দলটির নেতারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।  

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। গত ২৬ অক্টোবর নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা দল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টিও (বিডিপি) ওই পরিকল্পনার অংশ কিনা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক মহলে। কেননা জামায়াত অস্বীকার করলেও নতুন দলটির নেতারা সবাই জামায়াত-শিবিরেরই নেতা বলে জানা গেছে। 

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পর ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতিদের নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জামায়াতকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে খাপখাইয়ে চলতে হবে তা নিয়ে ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেখানে আর অন্যসব বিষয় ছাড়াও ভোটারদের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক সমর্থন তৈরি না হওয়ায় জামায়াতের বিকল্প দল গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়।

ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও জামায়াতের মজলিসে শুরার প্রভাবশালী সদস্য, যার পরবর্তিতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হয় সেই মীর কাশেম আলীর উদ্যোগে এই বৈঠকটি হয়েছিল। যদিও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া জামায়াতের আরেক নেতা তখনকার আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এই ধারণাপত্র গ্রহণ করেননি। তিনি ওই শিবির নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন।   

এতে তারা বলেছিলেন, দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর জামায়াত বাংলাদেশের মাটিতে কাজ করে ব্যাপক সাংগঠনিক মজবুত ভিত্তি অর্জন করলেও ভোটারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে সমর্থন তৈরি করতে পারেনি। বিএনপিও এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এজন্য জনগণ আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপি ও জামায়াতের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি দেখতে চায়। একই সময়ে কারাগার থেকে জামায়াতের নেতাদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া সংগঠনটির আরেক নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানও জামায়াতের বিকল্প হিসেবে নতুন দল গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালে নিবন্ধন বাতিল করার পর থেকেই নতুন একটি দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখে জামায়াত। বিশেষ করে ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করলে এবং জামায়াতকে বাইরে রেখে বিএনপি নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলে নতুন দলগঠনের জন্য জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর চাপ দেন শিবিরের সাবেক নেতারা, যারা বর্তমানে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বে রয়েছেন; কিন্তু জামায়াত সাংগঠনিকভাবে তখনও এমন সিদ্ধান্ত না নিয়ে এ ব্যাপারে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করে। পরবর্তীতে নিবন্ধন ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না দেখে এবং উপরন্তু তাদের সঙ্গে মিত্রদল বিএনপির দূরত্ব বজায় রাখার নীতি দেখে নতুন দল গঠনের একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানান সংগঠনটির বেশ কয়েক নেতা। 

তারা জানান, ২০১৯ সালের ১৬ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্বশীলদের চিঠি দিয়ে নতুন দল গঠনের জন্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের কথা জানায় দলটির শীর্ষকমান্ড। ওই চিঠি দেওয়ার আগে শুরার বিশেষ বৈঠকে নতুন দল গঠনের অনুমোদনও নেওয়া হয়। তবে নামকরণসহ দলটির ঘোষণা কবে দেওয়া হবে তা কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পর করোনা পরিস্থিতিতে এই প্রক্রিয়া কিছুটা থেমে গিয়েছিল। কয়েক মাস আগে আবারও কাজ শুরু হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করা বিডিপির চেয়ারম্যান এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম (চান) ও সেক্রেটারি জেনারেল নিজামুল হক (নাঈম)। আনোয়ারুল ইসলাম একসময় ছাত্রদল করতেন। আর নিজামুল হক ছাত্রশিবির করতেন। পরে দুজনই জামায়াতের রুকন (শপথকারী সদস্য) এবং ঢাকা মহানগরীর মজলিশে শুরার সদস্য হন। তাঁরা এখনো জামায়াতে ইসলামীতেই আছেন।

তবে দলটির চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম দাবি করেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নেই। তাঁরা দেশের সংবিধান মেনে রাজনীতিতে এসেছেন। সংবিধানের প্রতিটি শব্দ তাঁরা সম্মান করেন এবং সেটা লালন করেই রাজনীতি করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে বিডিপি গঠন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, বিডিপির চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম পেশায় আইনজীবী। তাঁর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল পৌরসভার চারিআনিপাড়ায়। তিনি ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জহুরুল হক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তাঁর বড় ভাই এ কে এম রফিকুল ইসলামও বিএনপির সৌদি আরব (পূর্বাঞ্চল প্রদেশ) শাখার সভাপতি ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আনোয়ারুল ছাত্রদল থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থাকলেও পরে ঢাকায় আইন পেশায় গিয়ে জামায়াতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি জামায়াতের ঢাকা মহানগর কমিটির মজলিশে শুরার সদস্য।

বিডিপির সেক্রেটারি জেনারেল নিজামুল হক ছাত্রশিবিরের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০১১ সালে শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দাওয়াহবিষয়ক সম্পাদক হন, পরের কমিটিতে আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

নিবন্ধনের আবেদনে বিডিপির কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কার্যালয় হিসেবে নয়াপল্টনে ‘চায়না টাউন’ নামে একটি বহুতল ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। আবেদনের সঙ্গে ১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকা দেওয়া হয়। এ কমিটিকে বিডিপির ‘জাতীয় স্থায়ী কমিটি’ বলে উল্লেখ করা হয়। ১৫ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের অধিকাংশই জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো না কোনো পর্যায়ের নেতা ছিলেন। কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে জামায়াতের রুকন বা শপথকারী সদস্য হন। তাঁদের একজন রাশেদুল ইসলাম (রানা) এক কমিটিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক ও পরে ছাত্রকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আরেকজন রিয়াদ হোসাইন, যিনি একসময় শিবিরের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন।

জানা গেছে, ইসিতে বিডিপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটির পৃথক তালিকাও জমা দেওয়া হয়। তাতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি পদে মনির উদ্দিন (মনি) ও সাধারণ সম্পাদক পদে রেজাউল করিমের নাম রয়েছে। মনির উদ্দিন ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সভাপতি ও পরে কেন্দ্রীয় হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট (এইচআরডি) সম্পাদক ছিলেন। রেজাউল করিমও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, ‘নতুন দল করলে জামায়াত ঘোষণা দিয়েই করত। জামায়াত নিষিদ্ধ দল নয় এবং দলের নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে করা মামলা এখনো সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন। এ অবস্থায় অনেকে না বুঝে নতুন দলটি জামায়াতের বলে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার চালাচ্ছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //