আওয়ামী লীগের সম্মেলনে থাকছে না চমক

অনেকটা নিয়ম রক্ষার সম্মেলন হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের। সম্মেলনকে ঘিরে সারাদেশে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলেও আসছে না বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন। বাড়বে না কমিটির কলেবরও। গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনার উদ্দেশ্যে তৃণমূলের মতামত চাইলেও নতুন কোনো সম্পাদকীয় পদ তৈরি হচ্ছে না। 

দেশে নতুন বিভাগ সৃষ্টির কার্যক্রম স্থগিত হওয়ায় আওয়ামী লীগেও নতুন পদ তৈরি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তবে বাড়তে পারে উপদেষ্টা পরিষদের আকার। আবার বর্তমান কমিটির জ্যেষ্ঠ নেতারা পেতে পারেন পদোন্নতি। নির্বাচনের এক বছর আগে অনুষ্ঠিত হওয়া এই সম্মেলনে আসতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখা। 

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়াদী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। ইতোমধ্যেই নেয়া হয়েছে সব ধরনের প্রস্তুতি। এবার সাদামাটা আয়োজন হলেও লক্ষাধিক নেতাকর্মীর সমাগমের টার্গেট আওয়ামী লীগের। 

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বৈশ্বিক অর্থ মন্দায় কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য সম্মেলন দুই দিনের জায়গায় হবে একদিন। ২০১৯ সালের সম্মেলনের বাজেট ছিল ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এবারের জন্য বাজেট ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা অনুমোদন করেছে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটি। ৩৫-৪০ হাজার কাউন্সিলর, ডেলিগেটস ও অতিথিসহ প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জন্য খাদ্য বাবদ ব্যয় হবে ১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। মঞ্চ ও সাজসজ্জায় ১ কোটি ২০ লাখ, প্রচার প্রকাশনায় ২০ লাখ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ১০ লাখ ও দপ্তরের কাজে ৫ লাখ টাকা। খরচ কমাতে বাদ দেওয়া হয়েছে আলোকসজ্জার পরিকল্পনা। আগের মতো বিশাল তোরণও থাকছে না।

সরেজমিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনস্থল পরিদর্শনে দেখা গেছে, মঞ্চ তৈরিসহ অন্য কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ২১ ডিসেম্বরের মধ্যে মঞ্চ বুঝিয়ে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে। আওয়ামী লীগের ভোটের প্রতীক নৌকার আদলে তৈরি মঞ্চে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ মেগা প্রকল্পগুলোর ছাপ থাকবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, এই কাউন্সিল থেকে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দেবেন এবং লক্ষ্য জানাবেন। সেই নির্দেশনা ও লক্ষ্য নিয়ে সারাদেশ থেকে আগত নেতাকর্মীরা আগামী এক বছর কাজ করবেন। 

দলের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ উপলক্ষে গঠিত সব উপ-কমিটি নিরলসভাবে কাজ করছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবারের সাদামাটা সম্মেলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কমানো হয়েছে খরচ। থাকছে না বিদেশ থেকে আসা অতিথি।

তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।’ 

গঠনতন্ত্রের পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কার্যনির্বাহী সংসদের আকার বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই। তবে যদি কোনো পরিবর্তন আনা হয়, তা সম্মেলনের পূর্বে সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সভায় চূড়ান্ত হবে।’ সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক ও শৃঙ্খলা উপ-কমিটির সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সম্মেলন যেহেতু সাদামাটা হবে, এতে নেতাকর্মীদের ঢল নামবে। তাই শৃঙ্খলাও বজায় রাখতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই। তাই শৃঙ্খলা না থাকলে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব না।’

কমিটিতে কী পরিবর্তন আসছে

বরাবরের মতো এবারও আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে কোনো পরিবর্তন আসছে না। এই পদে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনাই পুনর্নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার এই পদে থাকা নিয়ে দলের কারও কোনো দ্বিমত নেই বলে কাউন্সিলররা মনে করছেন। আবার সাধারণ সম্পাদক পদেও কোনো পরিবর্তন আসবে না বলেও জানিয়েছেন একাধিক শীর্ষনেতা। তবে আগামী নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে দলে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের নিয়ে আসা হতে পারে নতুন কমিটিতে। এই টার্গেট রয়েছে সাবেক ছাত্রনেতাদের দিকেই।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, আগে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন নিয়ে যে ধরনের আলোচনা হচ্ছিল, এখন সেই আলোচনায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে যেসব আলোচনা হচ্ছে, সেগুলো ধারণামাত্র। কাউন্সিলে কমিটি গঠনের ক্ষমতা সভাপতিকেই দেওয়া হয়। তাই দলীয় নেত্রী কী করবেন সেটা একান্তই তার ব্যাপার। তবে জাতীয় সম্মেলনের আগে সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচনের ফর্মুলার প্রভাব থাকতে পারে মূল দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, সাধারণত রেওয়াজ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর ডেলিগেটরা সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত করেন। সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা তার রানিং মেট হিসেবে দলের একজন নেতাকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ওই নেতাকেই কাউন্সিলর-ডেলিগেটরা কণ্ঠভোটে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে থাকেন। এই রেওয়াজেই আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়ে আসছে।

দলটির একাধিক সূত্রের দাবি অনুযায়ী, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বর্তমান দায়িত্ব পালনকারী ওবায়দুল কাদের ফের এই পদে নির্বাচিত হতে পারেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে এবারের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন নাও আসতে পারে বলে দাবি ওই সূত্রগুলোর। তবে পরিবর্তন এলে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের নাম বেশি শোনা যায়।

সূত্রগুলো দাবি করছে, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পর্যায়ে কয়েকটি পরিবর্তন হতে পারে। চার মেয়াদে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মাহবুব-উল আলম হানিফ ও দীপু মনি পেতে পারেন পদোন্নতি। সাধারণত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন নেতারা। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার প্রত্যাশায় বর্তমান কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান এবং আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ।

রেওয়াজ অনুযায়ী, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে চার মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী আহমেদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল ও আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপনের পদোন্নতি হতে পারে। সম্পাদকমণ্ডলীতে দায়িত্ব পালনে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করায় কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে আসতে পারেন সাংগঠনিক সম্পাদক পদে। সে ক্ষেত্রে সুজিত রায় নন্দী, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, নির্বাহী পরিষদ সদস্য রিয়াজুল কবির কাওসার ও আনোয়ার হোসেনের নাম আলোচনায় আছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রের দাবি, সরকার ও দলকে আলাদা করতে গত সম্মেলনে দলের দায়িত্ব থেকে বাদ পড়েন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তারা নতুন কমিটিতে ফিরতে পারেন বলেও ধারণা করছেন কেউ কেউ। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকীয় পদ থেকে বাদ পড়া একজন সাবেক মন্ত্রীও ফিরতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ পদে।

প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। এ পর্যন্ত দলটির ২১টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক পুনরায় নির্বাচিত হন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //