বিএনপি কেন ইসির সঙ্গে সংলাপ করতে চায় না

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ যেদিন প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা কী, তার প্রায় তিন মাস পরে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপিকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। 

বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে সংলাপে বসবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গত ৫ জানুয়ারি সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা কী? তিনি বলেন, নির্বাচনের আয়োজক সংস্থা নির্বাচন কমিশন। তারা প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসতে পারে। 

এরকম বাস্তবতায় গত ২৩ মার্চ নির্বাচন নিয়ে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপিকে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। ওই সংলাপে বিএনপির সমমনা দলগুলোও অংশ নিতে পারবে বলে জানানো হয়। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ইসির সঙ্গে আলোচনায় যেতে চায় না বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষ্য, ‘আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার, নির্বাচন কমিশনের কোনো আলোচনায় যাব না আমরা। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। এই সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলেই আমরা মনে করি।’ (মানবজমিন, ২৪ মার্চ ২০২৩)।

প্রশ্ন হলো, রাজনীতিতে নির্বাচন কমিশনের এই চিঠির গুরুত্ব কতখানি এবং বিএনপি এই সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করায় এটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলবে? সর্বোপরি এই প্রত্যাখ্যান কি তাদের মূল দাবি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে কোনো ভূমিকা রাখবে? 

প্রসঙ্গত গত বছরের ১৭ থেকে ৩১ জুলাই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন। ২৭টি দল সংলাপে অংশ নিলেও বিএনপিসহ ১২ দল সেই সংলাপের আমন্ত্রণ নাকচ করে। এবারও যেহেতু বিএনপি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের আমন্ত্রণ নাকচ করেছে, ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে তারা কি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপে বসবে? 

গত ১৪ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও কোনো সংলাপ করবেন না। তার ভাষায়, ‘প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়ে কথা রাখেন না।’ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপির আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল বলেন, ওই সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপির আর কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হবে না, পুলিশি হয়রানি হবে না, গায়েবি মামলা হবে না। কিন্তু এর তিন দিন পর থেকে বিএনপির প্রার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। (ঢাকা পোস্ট, ১৪ মার্চ ২০২৩)।

প্রশ্ন হলো, বিএনপি যদি প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাচন কমিশন, কারও সঙ্গেই সংলাপে বসতে না চায় তাহলে কার সঙ্গে বসবে? তারা কি মনে করছে যে সংলাপ বা আলোচনায় তাদের দাবি আদায় হবে না? যদি না হয় তাহলে তারা কি মনে করছে যে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করবে? সেই সক্ষমতা ও জনসমর্থন কি তাদের আছে?

এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, যেহেতু এর আগেও ইসির সংলাপে বিএনপি যায়নি এবং বিএনপির মূল দাবির বিষয়ে ইসির যেহেতু কিছু করণীয় নেই, সেখানে নতুন করে বিএনপিকে কেন সংলাপের চিঠি দেওয়া হলো? 

অনেকে মনে করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ আছে। তাছাড়া ইসি হয়তো নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্য বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে এই চিঠি দিয়েছে-যাতে তারা বহির্বিশ্বে এই বার্তাটি দিতে পারে যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে তারা আন্তরিক। বিএনপি যদি সংলাপে নাও আসে, তারপরও ইসি এটি বলতে পারবে যে, তারা বারবার বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে চেয়েছে, কিন্তু বিএনপি সাড়া দেয়নি। যদিও বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে কোনো দিক থেকে চাপ নেই বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন। (প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০২৩)

একদিকে তথ্যমন্ত্রী পরিষ্কার করে বলেছেন যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো প্রয়োজনীয়তা তারা দেখেন না। অন্যদিকে বিএনপি বলছে তাদের যে দাবি সেটি নির্বাচন কমিশন পূরণ করতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনও সে কথা স্বীকার করছে। তার মানে বিএনপির যে দাবি সেটি পূরণ করা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। অর্থাৎ সংলাপ হলে সেটি হতে হবে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই। কারণ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিধান ফিরিয়ে আনতে গেলে যে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেটির এখতিয়ার সংসদের, নির্বাচন কমিশনের নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের তরফে এ বিষয়ে অসংখ্যবার বলা হয়েছে যে, বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ সরকার বা ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেবে না। আর বিএনপির অবস্থানও স্পষ্ট যে, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। 

প্রশ্ন হলো, দেশের প্রধান দুটি দলের এরকম একটি বিপরীতমুখী অবস্থানে সেতুবন্ধ রচনার কাজটি কি নির্বাচন কমিশন করতে পারে? তারা কি দুই দলকে একসঙ্গে নিয়ে সংলাপে বসতে পারে? সেরকম একটি সংলাপ হলেও যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের মধ্যস্থতায়ও কি আখেরে কোনো ফল আসবে? যদি না আসে তাহলে সমাধান কী? 

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, সংলাপ বা আলোচনার মধ্য দিয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়নি। এই বাস্তবতা বিএনপিও জানে। যে কারণে গত ৬ মার্চ রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আমরা কোনো সংলাপ চাইনি, আমরা তো চেয়েছি সরকারের পদত্যাগ। (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ৬ মার্চ ২০২৩)।

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, আন্দোলনের মাঠ যার দখলে ছিল, ভোটের মাঠও ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে আন্দোলনের মাঠ বিএনপির দখলে নেই। উপরন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন খবর বলছে, রাজনৈতিক সংঘাত মোকাবিলায় পুলিশ বাহিনীকে আরও বেশি শক্তিশালী করা হচ্ছে। তার মানে সরকার কি মনে করছে যে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এবং সেজন্য পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে? পুলিশ প্রশাসন যদি সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে থাকে, তখন বিএনপি তাদের দাবি আদায়ে রাজপথেও কি খুব একটা সুবিধা করতে পারবে? 

অতএব আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে নির্বাচন কমিশন যে চিঠি দিয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে সেটিকে নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছার প্রকাশ বলে মনে হলেও নির্বাচন যে শুধু নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না, সেই বাস্তবতাটিও মাথায় রাখতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //