জামায়াতের সমাবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নাকি অন্য কিছু

প্রায় ১০ বছর পর প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে রাজধানীতে প্রকাশ্যে সমাবেশ করেছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। গত এক দশক ধরে প্রচণ্ড চাপে রাখার পর জাতীয় নির্বাচনের বছরে দলটিকে সরকার কেন মাঠে নামার সুযোগ দিয়েছে তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে জামায়াতের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের মনোভাব আগের চেয়ে নমনীয় হয়েছে। এই নমনীয়তার নেপথ্য কারণ নিয়েও শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ। কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। তবে অনেকে মনে করেন, নির্বাচন সামনে রেখে পর্দার আড়ালে হয়তো ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এ নিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের একটি বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন, ভোট ছাড়া সংসদীয় আসন ভাগাভাগির যে ছক কষছে সরকার, তাতে জামায়াতকেও রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানোয় স্বনামে ভোটে আসার সুযোগ নেই জামায়াতের; তাই অন্য নামে তাদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হতে পারে বলেও দাবি করেছেন জিএম কাদের। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জাপা চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এখনো। তাই সরকারি দল ও জামায়াতের গোপন যোগাযোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।

যদিও জামায়াত নেতাদের দাবি, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সরকারের আমলেই তারা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার নিজেদের অগণতান্ত্রিক আচরণ আড়াল করতে অন্য দলের সভা-সমাবেশে বাধা না দেওয়ার কৌশল নিয়েছে বলেও মনে করেন জামায়াতের নেতারা।

এদিকে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জামায়াত নিবন্ধিত দল নয়। কিন্তু তাদের মুরব্বি বিএনপি আবারও আগুন সন্ত্রাস করার জন্য জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে জামায়াত। কারণ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অন্যতম বড় প্রতিশ্রুতিই ছিল একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা। মানবতাবিরোধী অপারাধে জড়িতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা। আওয়ামী লীগ সেই বিচার কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়ার পর চাপ বাড়তে থাকে জামায়াতের।

পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে দলটির শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়। এরই অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও হারায় জামায়াত। যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকরের প্রতিবাদে দেশব্যাপী সহিংস কর্মসূচি পালন করতে থাকে দলটি। এর ফলে প্রশাসনিক বাধার মুখে পড়ে ২০১৩ সালের পর থেকে স্বাভাবিক কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি।

এ ছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে আগুন সন্ত্রাসের ঘটনায়ও জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অভিযুক্ত করে আসছে ক্ষমতাসীনরা। এরপর দলটির ওপর চাপ আরও বাড়তে থাকে। তখন থেকে মগবাজারে দলটির কেন্দ্রীয়, পুরানা পল্টনে মহানগর কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়গুলো অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই জামায়াত ও শিবিরকে বিভিন্ন ইস্যুতে ঝটিকা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার বলেন, ২০১৩ সালের ৪ মার্চ সর্বশেষ সমাবেশের অনুমতি পেয়েছিল জামায়াত। তখন শাপলা চত্বরে সমাবেশ হয়। এর আগে ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পল্টন মোড়ে সমাবেশে পুলিশের হামলা, সাংবাদিক সম্মেলন শেষে ৪ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করা হয়।

জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ঘরোয়াভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা। কিন্তু মাঠে কর্মসূচি না থাকলে রাজনৈতিক দল হিসেবে অস্তিত্ব রাখা মুশকিল। তাই দলীয় কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে আসতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা।

এ ছাড়া সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে জামায়াতের আমিরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার এবং সাধারণ নেতাকর্মীরা নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর এক্ষেত্রে দীর্ঘকালের মিত্র বিএনপির কাছেও কোনো সহমর্মিতা পাওয়া যায়নি। তাই জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালনে মন দিয়েছে জামায়াত।

যতদূর সম্ভব সংঘর্ষে না জড়িয়ে প্রশাসনের অনুমতিসাপেক্ষে মাঠের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি রীতিমতো আশীর্বাদ হয়ে এসেছে তাদের কাছে। এই নীতি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারের তরফ থেকে আগের মতো বাধা দেওয়ার প্রবণতা অনেকটা কমেছে। জামায়াত মূলত এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে।

জামায়াতকে মাঠে নামার অনুমতি দেওয়ার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল আমীন ব্যাপারী বলেন, ভিসানীতি অন্যতম একটি কারণ। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে এমন কথার ভিত্তি নিয়ে আমি সন্দিহান। কারণ এই সরকারের আমলে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাই দলটির সাধারণ নেতাকর্মীরা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা মেনে নেবে না।

বিভিন্ন সূত্র অবশ্য বলছে, সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে জামায়াত। কিছুদিন আগে সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদ্ল্লুাহ মো. তাহেরের বৈঠকও হয়েছে। যদিও সেই বৈঠকের কথা কোনো পক্ষ কখনো স্বীকার করেনি।

এমন বোঝাপড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জামায়াত কখনো সমঝোতা, ষড়যন্ত্র ও নীতিবিবর্জিত রাজনীতি করে না। যে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তারা কীভাবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে তা বোধগম্য না। সামনে নির্বাচন। এর আগে সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। এজন্য সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। অনুমতি না দিলে সবকিছু বিপক্ষে যাবে।

এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ভিসানীতির চাপের কারণে সরকার অনুমতি দিয়েছে কি না তা বিশ্লেষণ করবেন আপনারা। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার জামায়াতের রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //