আন্দোলন নিয়ে চাপে বিএনপি

দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি তার প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পূর্ণ করেছে গত ১ সেপ্টেম্বর। দলটি ৪৫ বছর পূর্ণ করল এমন এক সময়, যখন প্রায় ১৭ বছরের মতো দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে রয়েছে। 

বিএনপির নেতারা মনে করেন, আবার ক্ষমতায় ফিরতে আগামী দ্বাদশ নির্বাচন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে আওয়ামী লীগ সরকার যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে এই নির্বাচনেও তাদের জয়লাভ করা সম্ভব নয়। এজন্য গত বছরের জুলাই থেকে নানা কর্মসূচি পালনের পর চলতি বছরের ১২ জুলাই সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের এক দফার যৌথ ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো। তবে ২৮ জুলাই ঢাকায় একটি মহাসমাবেশের পরদিন ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোয় ‘সংঘর্ষপূর্ণ’ অবস্থান কর্মসূচিতে সেভাবে নেতাকর্মীরা না-নামায় সামনের দিনগুলোতে আন্দোলন জমাতে প্রমাদ দেখছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।

বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- অবস্থান কর্মসূচি শেষে প্রায় ১২ দিনের বিরতির পর পদযাত্রা, গণমিছিল নিয়ে এক দফার কর্মসূচিতে ফিরলেও সরকারকে চাপে ফেলতে পারে- এমন ধরনের কর্মসূচি নিতে পারেনি বিএনপি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবরণের মাস হওয়ায় আগস্টে বড় ধরনের কর্মসূচিতে যায়নি তারা। বিএনপির দাবি মানার ব্যাপারে সরকারের গা-ছাড়া ভাব এবং এ কারণে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে কোনো কর্মসূচি দিতে পারবে কি-না সেই লক্ষণও স্পষ্ট নয় বিধায় নেতাকর্মীদের এক ধরনের হতাশায় পেয়ে বসেছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খুলনার নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘২৮ জুলাই মহাসমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যের পর নেতাকর্মীরা নতুন কর্মসূচির জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এখনো তেমন কর্মসূচি আসছে না। এজন্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় কাজ করছে। 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এখনো কেন গণ-অভ্যুত্থান হচ্ছে না, এই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগের দিন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া কারও মানবাধিকার নেই। সাম্প্রতিক সব ঘটনাই দেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কেন এখনো গণ-অভ্যুত্থান হচ্ছে না? পরিবর্তন আনতে হলে বড় রকমের ঝাঁকুনি-সংগ্রাম দরকার। সে সংগ্রামে আমরা আছি। কিন্তু তা যথেষ্ট কি না, তা এখনই চিন্তা করতে হবে। সুনামির মতো অভ্যুত্থান ছাড়া এই দানবকে সরানো সম্ভব না।’

এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি গত ২ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেন, ‘আমরা এখনো ভোটগ্রহণের কোনো তারিখ ঠিক করিনি। আজকের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল।’

আগামী অক্টোবর মাসে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। বিএনপি চায়, এর আগেই তাদের এক দফা দাবি নিয়ে ফয়সালা করতে। হয় সরকার তাদের দাবি মানবে, না-হয় আন্দোলন বেগমান করে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। এক্ষেত্রে দলটি চলতি সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাপক আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।

নতুন কর্মসূচি প্রণয়নে ২ সেপ্টেম্বর রাতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই চলমান সরকার পতন আন্দোলনকে সফল পরিণতির রূপ দেওয়ার জন্য বেশিরভাগ নেতা মতামত দেন। চলমান আন্দোলনকে সফল করতে আদালত, সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিতে মতামত আসে বৈঠকে। তবে কোনো অবস্থাতেই হঠকারী কোনো কর্মসূচি না-নেওয়ার মতামত দেন সকলে বলে জানা গেছে।

এমন এক প্রেক্ষাপটে গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে ভার্চুয়ালি বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। সেখানে নতুন কর্মসূচি নিয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি এবার আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তা করছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আদালতের বিভিন্ন রায়ের প্রতিবাদে সমাবেশ, সেমিনার ও আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসূচি করার চিন্তা করছে দলটি।

কারণ বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও তাতে যেন বিএনপির জনপ্রিয় নেতারা অংশগ্রহণ করতে না-পারে তার জন্য পুরনো মামলায় বিচার কাজ দ্রুত গতিতে শেষ করা হচ্ছে। এখন সরকারবিরোধীদের দমন করতে আদালতকে ব্যবহার করছে। এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত।

এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুগ্ম মহাসচিবদের ভার্চুয়ালি যে বৈঠক হয়েছে তাতেও আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেন নেতারা।

স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, বৈঠকে আদালতের রায়ের প্রতিবাদে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ঢাকায় একটি সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সমাবেশ থেকে আদালতের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার না পাওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরা হবে। এরপর সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, আদালতে কীভাবে সেই মামলার বিচারকার্য চলছে, তা তুলে ধরতে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হবে। বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে ওই সেমিনারে আদালত ব্যবহার করে বিরোধী নেতা-কর্মীদের ‘দমনপীড়ন ও সাজা’ দেওয়ার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হবে। এরপর আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া হবে। এই কর্মসূচি বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের দিয়ে পালন করা হবে। একই দিন বিএনপিও একই দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ করতে পারে। 

বিএনপি সূত্র জানায়, কর্মসূচি ঘোষণার আগে আজ-কালের মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আছি। ধারাবাহিক আন্দোলনে পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মসূচির ধরনে পরিবর্তন আনতে হয়। এটিই আন্দোলনের ধারা। অচিরেই নতুন কর্মসূচি আসবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //