বিএনপি কি ভোট বয়কটের পথেই

রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কি আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করতে যাচ্ছে? ২৮ অক্টোবর-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে দেশের রাজনৈতিক মহলে এখন এই প্রশ্ন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। আবার দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ দলেরই ‘নির্বাচনমুখী’ একটি বড় অংশকে নিয়ে নতুন দল গঠন অথবা দ্বাদশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন বলে গুঞ্জন উঠেছে।  

আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত বলে ৭ নভেম্বর মঙ্গলবার বক্তব্য দিয়েছেন এই নেতা। নতুন দল করছেন এবং নির্বাচনে যাচ্ছেন এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে গণমাধ্যমের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়েছেন কৌশলে। তবে ৮ নভেম্বর তার বনানীর বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, “শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। বিএনপির রাজনীতি থেকেও অনেকটা দূরে। আমি অন্য দল গঠন করতে যাচ্ছি তথ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্য সঠিক নয়। আমি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বর্তমানে জড়িত নই।” তিনি মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর নির্ভর না করে বিকল্প পথ খুঁজে বের করা উচিত। আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যস্থতায় বিএনপির এই নির্বাচনে যাওয়া উচিত। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ শক্তি।”

বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো তাদের ‘নির্বাচনকালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি’ আদায়ে একদিকে যেমন অনড় রয়েছে অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন এগিয়ে যাচ্ছে তফসিল ঘোষণার পথে। আর সরকারি দলের বক্তব্য, ‘নির্বাচন হোক বিএনপি আসলে সেটা চায়ই না। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করাকে কেন্দ্র করে হরতাল এবং অবরোধ কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে রাজপথে ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। বিএনপি নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তার ও আটকের হিড়িক শুরু হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে কূটনৈতিক মহলেও। তারাও অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা জোর দিয়ে বলছেন।’

বিএনপির দাবিও তাই। দলটি শুরু থেকেই বলে আসছে, বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার অধীনে কোনো সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। এজন্য তারা সরকার পদত্যাগ করে অবিলম্বে নির্বাচনকালীন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে আসছে। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারি একটি নির্বাচন পরিচালনা করবে। গত ১২ জুলাইয়ের পর থেকে এ দাবিতে এক দফার আন্দোলন করে আসছে বিএনপিসহ তার সমমনা দলগুলো। বিএনপির অভিযোগ, সরকার তাদের এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করছে না। ক্ষমতাশীলরা বরাবরের মতো আগামী দ্বাদশ নির্বাচনও তাদের নেতৃত্বেই করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘কে চোখ রাঙাল, আর কে বাঁকাল, ওটা নিয়ে আমরা পরোয়া করি না। কারণ, অনেক সংগ্রাম করে, ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেই কিন্তু আজকে আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সব সংশয় আর অনিশ্চয়তার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি বলেন, ‘একটা কথাই বলব, নির্বাচন হবে এবং সময়মতোই হবে। কেউ আটকাতে পারবে না।’

একটি সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে দেশের বন্ধুপ্রতিম পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র,ক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ এ ব্যাপারে সরকার এবং দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে যারা বাধা সৃষ্টি করবে বা বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের ব্যাপারে ভিসানিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, আলোচনার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হলে শেষ পর্যন্ত ভোটের বাইরেই থাকবে বিএনপির মূলধারা। সরকার শর্তহীনভাবে এলে আলোচনার যে কথা বলেছিল তার সময়ও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই অবস্থায় দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কিছু নেতা নির্বাচনে চলেও আসতে পারেন- এমন আলোচনাও শুরু হয়েছে জোরেশোরে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে টানা যে আন্দোলন আমরা করছি, তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ভোট আয়োজন। আমরা চাই দেশে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। কিন্তু সরকার আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করছে না। তারা আগের মতোই নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ বিএনপির এই অন্যতম নীতিনির্ধারক বলেন, ‘এই সরকারের আয়োজনে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে অংশগ্রহণ করে আমরা তো ভুয়া নির্বাচনকে বৈধতা দিতে পারি না।’

বিএনপি এর আগেও নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। তবে অংশ নিয়েছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও একজন পুলিশকে হত্যা করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা- এমন অভিযোগে দলের ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেয় পুলিশ। এর পরদিন থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির তিন সদস্যসহ জ্যেষ্ঠ কেন্দ্রীয় নেতা, তৃণমূলে আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে- এমন নেতাকর্মীদের একের পর এক গ্রেপ্তার চলছে।

পুলিশ অবশ্য বলছে, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে অথবা গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, তারা সবাই পুলিশ হত্যা, আগুনসন্ত্রাস ও সহিংসতার আসামি। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেন এমন সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার রায়ে সাজাও দেওয়া হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা। এই নির্বাচন সামনে রেখে ৪ নভেম্বর আমন্ত্রণ পাঠানো ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৬টির সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসি। সংলাপে বিএনপিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। একজন পথচারীকে সাক্ষী রেখে আমন্ত্রণপত্রটি দলটির নয়াপল্টনের তালাবদ্ধ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটের পাশে থাকা একটি চেয়ারে রেখে আসেন ইসির এক বার্তাবাহক।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘দলের মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই জেলে, অনেকে রিমান্ডে, কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। যেসব নেতা বাইরে রয়েছেন, তাদের বাসাবাড়িতে তল্লাশি করা হচ্ছে। অনেকে রাতের পর রাত তাদের বাড়িতে থাকতে পারছেন না। এই অবস্থায় কিসের সংলাপ?’ উল্লেখ্য, ওই দিন ইসির সংলাপে বিএনপিসহ ১৮টি দল অংশ নেয়নি।

এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক এম. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিএনপির অনেক নেতাকর্মী আটক আছে। সরকার থেকেও বলা হচ্ছে, তারা (বিএনপি) আসতে চায় না। অর্থাৎ সরকার বলছে-  তারা যেসব কাজকর্ম করছে, তাতে তো তারা নির্বাচনে আসতে চায় বলে মনে হয় না। এখন বিএনপি যেসব কর্মসূচি দিচ্ছে বা দিতে যাচ্ছে, তাকে তো নির্বাচনমুখী কর্মসূচি বলা মুশকিল। জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ- এগুলো তো নির্বাচনের কাজ না। নির্বাচনের কাজ হলে (নির্বাচনে যেতে চাইলে) তো তারা নির্বাচন কমিশনে (সংলাপে) আসত বা কোনো কিছু দিত। কিন্তু সেটা তো দেখছি না। এখনকার বাস্তবতায় তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে- এমন ইঙ্গিত তো পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না- এ কথা বলে না। তারা নির্বাচন চায়, তবে নির্বাচনটা কেয়ারটেকার সরকারের আওতায় হতে হবে। এইটা তাদের দাবি। এখন যদি সেই ধরনের পরিবেশ না হয় তাহলে তারা হয়তো নাও আসতে (নির্বাচন) পারে। এখনকার বাস্তবতায় তাদের (বিএনপি) আসার (নির্বাচনে) সম্ভাবনা কম।’

তবে তিনি বলেন, ‘তার অর্থ এই নয় যে, এখনো এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। শুভবুদ্ধির উদয় হলে, সকলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়ে অবস্থার পরিবর্তন হলে আমার ধারণা সকলেরই নির্বাচনে আসা উচিত। আর এটা হলে দেশের মঙ্গল হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //