আমার দেখা হায়দার আকবর খান রনো

কমরেড হায়দার আকবর খান রনো ভাই চলে গেলেন, এ কথা মেনে নেওয়া কষ্টের। কিন্তু পৃথিবীর এ অমোঘ সত্যটি মেনে নিতেই হয়। পরিপূর্ণ বামপন্থি আদর্শে দীক্ষিত একজন মানুষ যে কতটা লড়াকু মানসিকতার অধিকারী হন, রনো ভাই তারই স্বাক্ষর রেখে গেলেন।

দীর্ঘদিন ধরে সিওপিডিতে ভুগতে থাকা রনো ভাই ২০২০ সালের জুনে করোনায় আক্রান্ত হলে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন এবার তিনি থেমে যেতে চলেছেন। কিন্তু না, তিনি থামেননি। পাহাড়সম মনোবল ফিরিয়ে এনেছিল তাকে। তবে করোনা একেবারেই তাকে দুর্বল করে দেয়, ফলে ধানমন্ডির ওই বাড়ি ছেড়ে কোথাও আর যেতে পারতেন না। নাকে সারাক্ষণ অক্সিজেনের নল তার সঙ্গী, ঘরের মধ্যে একটু হাঁটলেই পালস বেড়ে যেত, অক্সিজেন কমে যেত, হাঁসফাঁস করতেন। সেই সঙ্গে দম বন্ধ করা কাশি। দৃষ্টিশক্তি বলতে আর তেমন কিছুই ছিল না। বই পড়তে পারতেন না বলে খুব কষ্ট পেতেন। কিন্তু দমে যাওয়ার মানুষ হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে একজন শ্রুতিলেখকের সাহায্যে বেশকিছু বই তিনি লিখে ফেলেন! শ্রুতিলেখকের নাম ছিল ‘অন্তু’। অন্তু ভাই টাইপ করার পাশাপাশি বই পড়েও শোনাতেন রনো ভাইকে।

আমি এই অবস্থাতেই রনো ভাইয়ের সান্নিধ্যে এসেছি। প্রথম সাক্ষাতেই তার বিস্তৃত জ্ঞানের পরিধির এক দিগন্ত আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়। মনে হতে থাকে কত কিছুই তো শেখার-জানার বাকি। প্রতিবার সাক্ষাৎ শেষ করে আমি যখন বিদায় নিয়ে তার রুমের দরজার কাছাকাছি এসে পেছনে ফিরে তাকাতাম, দেখতাম শূন্য দৃষ্টিতে তিনি বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন। একদা হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিকের ভিড়ে মধ্যমণি হয়ে থাকা রনো ভাইকে এভাবে দেখে মন খারাপ হয়ে যেত প্রতিবার। তবে এমন পরিস্থিতিতে নাসির ভাইয়ের কথা বলতেই হয়, বহুবার দেখেছি তিনি রনো ভাইয়ের সামনে বসে আছেন, ইউটিউব থেকে স্পিকারে কোনো খবর কিংবা টকশো শোনাচ্ছেন। নাসির ভাই ও নূরজাহান আপা ছিলেন রনো ভাইয়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। অনেক আন্তরিকতার সঙ্গেই তারা রনো ভাইয়ের দেখভাল করেছেন, রনো ভাইও সে কথা অকপটে বলেছেন অনেকবার। হাসপাতালে রনো ভাই যখন শেষ শয্যায়, এই দুজন মানুষ অঝোরে কেঁদেছেন। 

রনো ভাই গল্প বলতে পছন্দ করতেন। গল্প বলতে পুরনো দিনের স্মৃতির বর্ণনা। তার ১০ বছর বয়সের এক তরতাজা স্মৃতি ছিল, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে যশোরে প্রচারে আসা শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের বক্তব্য প্রত্যক্ষ করা। একবার সে বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লাইন ফজলুল হকের অনুকরণে শোনালেন আমাকে। রনো ভাই এত সুন্দর করে অনুকরণ করেছিলেন যে, তাতে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে যাই। এরপর বেশ কয়েকবার ঘরোয়া আড্ডায় পরিচিত অনেকের উপস্থিতিতে রনো ভাইকে অনুরোধ করেছিলাম বক্তব্যটা আবারও অনুকরণ করে দেখাতে, মৃদু হেসে করে দেখিয়েছিলেনও একবার। ফজলুল হকের বক্তব্যটা ছিল এমন, ‘ভাইসব, আমার বয়স এখন ৮০। এ বয়সে আমার কবরে থাকার কথা। কিন্তু আল্লাহর কী ইচ্ছে দেখেন, আমি এখন আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমি ভাবলাম, কেন আল্লাহ আমাকে এখনো কবরে নেননি! ওই মুসলিম লীগ সরকারকে কবরে পাঠানোর জন্য আল্লাহ আমাকে কবরে নেননি, ভাইসব আপনারা মুসলিম লীগ সরকারকে কবর দেন! কবর দেন!’ 

রনো ভাইয়ের কথায় বারবার উঠে আসত তার নানা সৈয়দ নওশের আলী, বাবা হাতেম আলী খান এবং মা কানিজ ফাতেমা মোহসীনার গল্প। বলতে বলতে হারিয়ে যেতেন সুদূর অতীতের স্মৃতির অতলে। তখন আমি অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করতাম না। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যেতাম। তার হায়দার আকবর খান রনো হয়ে ওঠার পেছনে যে, এ মানুষগুলোরই মূল ভূমিকা ছিল তা বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়াই ছিল এর অন্যতম কারণ।

মওলানা ভাসানীর প্রতি রনো ভাইয়ের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। কেউ একপেশে সমালোচনা করলে রনো ভাই তার প্রতিবাদ করেছেন মুখে বলে কিংবা পত্রিকায় লিখে কমরেড হায়দার আকবর খান ।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে দুরন্ত যাত্রা রনো ভাই শুরু করেছিলেন, তার শেষ হলো ১১ মে রাত ২টা ৫ মিনিটে। মওলানা ভাসানীর অনুসারী, ষাটের দশকে আলোচিত ত্রয়ী ‘জাফর, রনো, মেনন’-যারা পুরো দশক ছিলেন ছাত্র ও শ্রমিক রাজনীতির প্রথম সারির নেতা, মুক্তিযুদ্ধে তাদের ছিল অসামান্য ভূমিকা। স্বাধীনতার পরেও বেশকিছু বছর এই তিন আলোচিত নেতা একসঙ্গে অনেকটা পথ চলেছেন। এরপর কাজী জাফরের পথ আলাদা হয়ে যায়, রনো-মেনন বামে থেকে আরও বহু বছর একসঙ্গে চললেন। তারপর তাদেরও রাজনৈতিক পথ আলাদা হয়ে গেল। এখন রনো ভাই তো চলেই গেলেন অনন্তের পথে। শেষ হলো একটা অধ্যায়। সততা ও আদর্শের প্রশ্নে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো কখনো আপস করেননি, তার সাক্ষ্য ইতিহাস দিয়ে যাবে অনন্তকাল ধরে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //