নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:০৫ পিএম
আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:৫৬ পিএম
দুই যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে একসঙ্গে রাজনীতি করে আসছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। বিগত শেখ হাসিনার সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনে দমনপীড়নের স্বীকার হয়েছেন দুটি দলেরই নেতাকর্মীরা। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর ভাঙন ধরেছে দল দুটির রাজনৈতিক যৌথতায়। অবিশ্বাস, মতবিরোধ ও টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডানপন্থি ধারার দল দুটি পরস্পরের বিরোধী শক্তি হিসেবে হাজির হতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
বিশ্লষকদের মতে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর রাজনীতির মাঠে নেই আওয়ামী লীগ। জনগণের ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানোর দায় থাকায় ভবিষ্যতে দলটি রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে মাঠ দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সমর্থন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। এতে তাদের মধ্যে মতবিরোধও বাড়ছে।
নির্বাচন নিয়ে বিপরীত অবস্থান
শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি মূলত প্রকাশ্যে আসে গত আগস্টের মাঝামাঝি। অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের সময় দেওয়া নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেন দল দুটির নেতারা।
গত ৮ই অগাস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই ভাষণে জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, কিংবা নির্বাচন কতদিন পর হতে পারে এমন কোনো বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা ছিল না।
এ কারণে বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় অসন্তোষ জানান।
মির্জা ফখরুলের এই প্রতিক্রিয়ার সময় ফেনী-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা চলছিল।
এমন অবস্থায় বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের সমালোচনা করে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘এখনও শত শত মানুষ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। রক্তের দাগ মোছেনি। বন্যায় দেশ আক্রান্ত। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না।’
জামায়াত প্রধানের এই বক্তব্য ভালভাবে নেয়নি বিএনপি।
পরে এর জবাবে দলটির মহাসচিব ফখরুল বলেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে।’
রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন প্রতিপক্ষ ছিল, তখন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটা জোট ছিল। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ না থাকায় এখন ভিন্ন সমীকরণে এই মত পার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়।’
নিয়োগ নিয়ে বিরোধ
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা সরে যাচ্ছেন কিংবা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব জায়গায় নিজস্ব লোকের পদায়ন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এক ধরনের নিরব মনোমালিন্য চলছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে এই জটিলতা দেখা দেয় গত আগস্ট মাসে।
তখন আভাস মেলে বিএনপিপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। একটি দলের সরাসরি কেন্দ্রীয় নেতাকে ভিসি নিয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হয়। পরে তাকে নিয়োগ না দিয়ে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্যের দলীয় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে তিনি জামায়াত সমর্থিত হওয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন এমন ধারণা অনেক বিএনপি সমর্থকের। এ নিয়ে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করতেও দেখা গেছে।
এছাড়া গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তোলেন জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী। এ ঘটনায় কড়া সমালোচনা করেন বিএনপি সমর্থকরা।
ইসলামী দলের ঐক্য নিয়ে টানাপোড়েন
গণঅভ্যুত্থানের পর ইসলামী ও সমমনা দলগুলো নিয়ে একটি বৃহত্তর জোট গঠনের উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। বৃহৎ জোট গঠনে আলোচনা শুরু হয় গত ১৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কওমি মাদরাসাভিত্তিক কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে। এতদিন ইসলামী দলগুলোর নিজেদের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকলেও এই প্রথম সব বড় ইসলামী দলগুলো এক হতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্ত ঐক্যমতে পৌঁছালে তখন জোটবদ্ধভাবে সব ইসলামী দল নির্বাচন করবে বলে মনে করছে জামায়াত।
দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘ইসলামী দলগুলো একসাথে নির্বাচন করবে বলে আমরা আশাবাদী। সকল ইসলামী দলের মধ্যে একটা ঐক্যের আকুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অতীতে যে আগ্রহ কখনও দেখা যায়নি।’
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এতদিন আওয়ামী লীগ মাঠে থাকা অবস্থায় বিএনপির যারা ভোট ব্যাংক ছিল, সেখানে জামায়াত হাত দিচ্ছে। ইসলামী দলগুলো নিয়ে জামায়াতের ঐক্য হলে বিএনপির সাথে তাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার প্রশ্ন চলে আসবে।’
আওয়ামী লীগকে ফেরার ‘সুযোগ’ দেওয়া নিয়ে বিরোধ
গণঅভ্যুত্থান ঘিরে ব্যাপক দমনপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালানোর পর আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও বিরোধ রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের। গত ৪ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জানান, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক সেটি তারা চান না। আওয়ামী লীগ সামনের নির্বাচনে অংশ নিলেও আপত্তি নেই বিএনপির। ফখরুল মনে করেন, আওয়ামী লীগের যারা অপরাধ করেছে, শুধু তাদেরকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা ও বিচার করাই যথেষ্ট। এদিকে গতকাল রবিবার (১৩ অক্টোবর) এক দলীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের ‘সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি’ দল হিসেবে অভিহিত করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি করা হবে কি না সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। উল্লেখ্য, নিজেদের পতনের আগে কয়েক দিন আগে জামায়াত ও দলটির সহযোগী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
ভারতীয় গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক
বিএনপি-জামায়াতের মধ্যকার সাম্প্রতিক বিরোধের বিষয়টি নজর এড়ায়নি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারেরও।
গত ৩১ আগস্ট সংবাদমাধ্যমটিতে ‘নতুন মেরুকরণ, জামায়াতকে নিয়ে বিরক্ত বিএনপি’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘৮ আগস্ট ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে বিএনপি নেতৃত্ব সেই সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু ক্রমেই বিএনপির ধারণা হয়েছে, বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে গুরুত্ব তারা পাচ্ছে না। বরং জামায়াতে ইসলামী বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে উপদেষ্টাদের কাছে। নিয়োগ এবং বদলির ক্ষেত্রেও জামায়াতের পছন্দই গুরুত্ব পাচ্ছে। শুক্রবারও ৮১ জন বিচারককে বদলি করেছে সরকার।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে ফেরানোর বিষয়ে তৎপরতা নেই। আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ঢালাও খুনের মামলা দেওয়া এবং আদালতে তাদের মারধর খাওয়ানো নিয়েও সরব হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল। তারেক এ দিনও বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কঠিন পরীক্ষা। ইসলামি বাংলাদেশকে ঠেকাতে সেই পরীক্ষায় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার দলের একই অক্ষে মেরুকরণের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ।’
বিএনপি ও জামায়াতের দীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাস
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে। তখন থেকে থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশ বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় জামায়াতের। ১৯৯৯ সালে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে জামায়াতে ইসলাম।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে কিছু টানাপোড়েন তৈরি হয়। তবে জোট নিয়ে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হয়নি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এক সাথে অংশ নেয় দল দুটি।
২০০৯ থেকে ২০২৪ একটানা সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করেছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে শুধু জামায়াতের না বিএনপিরও এক নেতার ফাঁসি হয়েছে। ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গৃহবন্দী ছিলেন। এই সময় জামায়াত বিএনপির মধ্যে নানা সংকট হলেও রাজনৈতিক জোট ছিল দুই বছর আগ পর্যন্ত। এমনকি নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াতের প্রার্থীরা ভোটে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে।
২০২২ সালে দুই দল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনে শুরু করে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে গত ১ আগস্ট জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরই সশস্ত্র বাহিনীর সাথে বৈঠক, নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়া কিংবা শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান সব জায়গায় বিএনপি ও জামায়াত একসাথেই অংশ নিয়েছে। তাদের সঙ্গে ছিল গত ১৫ বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকা অন্য আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বিএনপি-জামাত নির্বাচন ইসলামী দল গণঅভ্যুত্থান
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh