নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫০ পিএম
আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫১ পিএম
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—সংবিধানের এই চার মূলনীতি হুবহু বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক ট্যাগ’ দিয়ে অস্বীকারের প্রবণতা রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সংগঠনটি।
বিষয়টিকে ‘দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক’ বলে উল্লেখ করেছে তারা।
ঐক্য পরিষদ বলেছে, এই অস্বীকার করা এবং প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় না আনার কারণে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সংখ্যালঘুরা আরও হুমকির মুখে পড়েছে, পড়ছে।
‘বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের লিখিত বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তরে এসব কথা উঠে এসেছে। আজ বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গত ৪ মাস ১১ দিনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে ঐক্য পরিষদ। তাতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট থেকে একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭৪টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, এই ১৭৪ সহিংসতার ঘটনায় ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। এ ছাড়া ৬৪টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; ১৫টি কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন; ৩৮টি বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং ২৫টি জোরপূর্বক বাড়িঘর, জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।
মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, তারা মনে করেন, প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যাদি সার্বিক ঘটনাবলির আংশিক চিত্র। কারণ, তাঁদের স্থানীয় নেতারা অব্যাহত হুমকি-হামলা এবং মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত থাকায় এবার মাঠপর্যায় থেকে সাংগঠনিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি।
এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। সেদিন তারা বলেছিল, গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে ঘিরে গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তারা এসব তথ্য সংগ্রহ করেছিল সারা দেশে থাকা তাদের সংগঠনের শাখাগুলোর মাধ্যমে।
অবশ্য ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, সেই ২ হাজার ১০টির মধ্যে ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগ অনুসন্ধান করে পুলিশ। অনুসন্ধান করা অভিযোগগুলোর মধ্যে ১ হাজার ২৫৪টির সত্যতা পাওয়া গেছে এবং ১৬১টির সত্যতা পাওয়া যায়নি। যে অভিযোগগুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১ হাজার ২৩৪টি (৯৮ দশমিক ৪%) ঘটনাই ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে। ২০টি (১ দশমিক ৫৯%) ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রদায়িক কারণে।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, রাজনৈতিক হামলার ঘটনাকে রাজনৈতিক বলা হচ্ছে কি না? জবাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, এমন অপরিপক্ব কথাবার্তা বলে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন–নিপীড়নকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
‘মব জাস্টিস’ হয়ে থাকলে সেটারও বিচার করতে হবে উল্লেখ করে নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, সব অপরাধীর বিচার করতে হবে। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করেন, তাঁরা আসলে সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি। তাঁদের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতাও ক্রমেই বাড়ছে বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন মনীন্দ্র কুমার নাথ।
এই সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ঊষাতন তালুকদার ও নির্মল রোজারিও, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু, সাংগঠনিক সম্পাদক দিপংকর ঘোষ প্রমুখ।
ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেছে, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সরকারের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
তারা বলেছে, মব জাস্টিসের নামে এই বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে। এর শিকার অনেক শিক্ষক আজও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে পারেননি।
ঐক্য পরিষদ বলেছে, পুলিশের ৪০তম ক্যাডেট উপপরিদর্শক (এসআই) পদে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ৮০৪ জনের মধ্যে চার ধাপে ৩২১ জনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০৩ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। অব্যাহতি পাওয়া ৩৩ জন নারীর মধ্যে ১৬ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাঁদেরকে রাজশাহী সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণকালে কথিত শৃঙ্খলাভঙ্গের ঠুনকো অভিযোগ এনে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ঐক্য পরিষদ বলেছে, গত ১৫ ডিসেম্বর ৪০তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণকালে ৬৬ জনের মধ্যে ২৫ জনকে অজানা কারণে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। পরে তাদের মধ্যে ২১ জনকে বাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৯ জন রয়েছেন।
৪৩তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে যাচাইয়ের নামে ২২৭ জনকে বাদ দেওয়া হয় উল্লেখ করে ঐক্য পরিষদ বলেছে, বাদ পড়াদের মধ্যে ৮২ জনই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হাইকোর্টে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উল্লেখ করে ঐক্য পরিষদ বলেছে, উচ্চতর আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া ২২৮ জনের মধ্যে মাত্র একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সরকারি কর্ম কমিশনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি।
ঐক্য পরিষদ বলেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি এ ধরনের আচরণ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সংখ্যালঘুদের পর্যায়ক্রমিক নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।
চার মূলনীতি হুবহু রাখার দাবি
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলনে বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—সংবিধানের এই চার মূলনীতি হুবহু বহাল রাখতে হবে। সংবিধানের রাষ্ট্রধর্ম–সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংসদে সংখ্যালঘুদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে এই সম্প্রদায়ের সরাসরি ভোটে ৬০টি আসন সংরক্ষণ করার প্রস্তাব রেখেছে সংগঠনটি।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ সারা দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু অনেক নেতার বিরুদ্ধে করা সব ‘হয়রানিমূলক’ ও ‘মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহার এবং তাঁদের মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh