উপন্যাস আদতে কতটা আধুনিক?

শোয়েব করিম

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০৯:২১ পিএম

স্টিভেন মুর। ফাইল ছবি

স্টিভেন মুর। ফাইল ছবি

মার্কিন সাহিত্য সমালোচক স্টিভেন মুর তার দ্য নভেল এন অল্টারনেটিভ হিস্ট্রির দুখণ্ডের প্রাচীন থেকে ১৮০০ শতকের, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের উপন্যাসের বিবিধ আদি ও আধুনিক আলামত উদ্ধার করেছেন, সেসবকে দেখতে চেয়েছেন উপন্যাসের নানা বোঝাপড়ার জায়গা থেকে, আবিষ্কার করেছেন প্রাচীনে আধুনিকে ফারাক ঘোচানো বিন্দুগুলো। তার বীক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক এই- তিনি উপন্যাসকে দেখেছেন বিবর্তনশীল প্রপঞ্চ হিসেবে, যাতে পষ্ট হয়ে ওঠে এইক্ষেত্রে একাডেমিয়ায় (পশ্চিমা বলে বিশেষায়িত করার জররুত আমরা এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পেরেছি?) লালিত অনৈতিহাসিকতা এবং একদেশদর্শিতাপ্রসূত সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্স আর সংকীর্ণতা, যা নিশ্চয়ই কেবল উপন্যাসের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত প্রবন্ধটি, বই দুটির কোনো অংশবিশেষ নয়, সারকথাও নয় বরং এতে আমরা পরিচিত হই তার সেসব বোধ ও প্রেরণার সঙ্গে, যা কিছু তাকে বই দুটো রচনায় প্রবৃত্ত করেছে....

উপদেশদাতারাই আমাকে পথভ্রষ্ট করেছে, বার্টি উস্টার যেমন বলতেন। সত্তরের দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, আমাদের বিশ্বাস করতে শেখানো হয়েছিল উপন্যাসের উৎপত্তি ১৮ শতকে ইংল্যান্ডে, আশির দশকে যখন পিএইচডি করছিলাম তখনো কেউ ভিন্ন কথা বলেনি। কখনো কখনো ডেনিয়েল ডিফোর রবিন্সন ক্রুসোকে আদিরূপ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, সাহিত্যের গোঁড়া মতানুযায়ী, ১৭৪০ সালে স্যামুয়েল রিচার্ডসনের পত্র উপন্যাস পামেলার মাধ্যমেই উপন্যাসের জন্ম, উপন্যাসটি যেন কুমারী মায়ের সন্তান। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতার দেয়ালের বাইরে, সেসব বিকল্প ক্লাসরুমে যেগুলোকে আমরা পুরোনা বইয়ের দোকান বলি, সেসবে আমি একের পর এক বই খুঁজে পাই যেগুলো দেখতে উপন্যাসের মতোই কিন্তু অবশ্যই পামেলার চেয়ে পুরোনো। ১০১০ সালের দিকে লেখা বিশাল উপন্যাস লেডি মুরাসাকির টেল অব গেনজিই শুধু নয় বরং কয়েক দশক আগে লেখা হ্রস্যতর উপন্যাস টেল অব লেডি অচিবুকোও সেখানে ছিল।  খুঁজে পাই দ্য স্টোরি অব ব্রান্ট জাঁল বইটা, ১৩ শতকের একটা আইসল্যান্ডিক ফিকশন যাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল সাগা হিসেবে, কিন্তু সেটা ছিল অনেক বেশিই বাস্তববাদী উপন্যাসের মতো। পেয়েছি দ্য গোল্ডেন লোটাস-এর মতো বহু খণ্ডে রচিত মিং ডাইনেস্টির চীনা উপন্যাস, শেক্সসপিয়ারের সমসাময়িক একটা নির্মম রকমের বাস্তববাদী উপন্যাস। পেয়েছি রবার্ট গ্রেভসের হোয়াইট গডেস এবং তাতে দ্য রিকগনিশন নামের উপন্যাসের রেফারেন্সে আশ্চর্য হয়েছি, যা কিনা চতুর্থ শতকের। চতুর্থ শতকেও উপন্যাস ছিল?

অবশ্য তেমন ফিকশনের দেখাও পেয়েছি, যেটা প্রচলিত উপন্যাসগুলোর সঙ্গে মেলে না বরং মনে করিয়ে দেয় অপ্রচলিত, নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসগুলোর কথা, যেগুলো আমি তখন পড়ছিলাম। এপুলিয়াসের গোল্ডেন অ্যাস (১৬০ খ্রিস্টাব্দে রচিত) পড়তে জন বার্থ যেমন লিখতেন, তেমনই লাগছিল, যেখানে পেট্রোনিয়াসের সেটেরিকন (এক শতাব্দী আগে রচিত) পড়ে লাগছিল থমাস পিঞ্চনের উপন্যাসের মতো। রেবেলিয়াসের লেখা ষোড়শ শতাব্দীর গারগান্টুয়া ও পেন্টাগ্রুয়েল মিলে যাচ্ছিল ২০ শতকের যেকোনো গারগান্টুয়ান রেবেলিশিয়ান উপন্যাসের সঙ্গে, জেমস জয়েসের ইউলিসিস থেকে শুরু করে গিলবার্ট সরেন্টিনোর মুলিগান স্ট্র পর্যন্ত।

আমার কাছে এটা পরিষ্কার, প্রকরণ নির্ধারণের পদ্ধতিতে একটা সমস্যা এ ক্ষেত্রে আছে। উপন্যাস বলতে মানুষ ‘প্রচলিত’ অথবা ‘আধুনিক’ অথবা ‘বাস্তববাদী’ উপন্যাসই বোঝে। কিন্তু আমি একে বিষেশায়িত করা বিশেষণের চেয়ে বিশেষ্যে আগ্রহী। আমি উপন্যাস বলতে বইজোড়া ফিকশন বুঝি, যে সংজ্ঞাটি ওয়েবস্টারের ডিকশনারি এবং ইএম ফস্টারের আসপেক্টস অব নভেল অনুমোদিত- অন্যদিকে বেশির ভাগ সাহিত্যের অধ্যাপক পরিভাষাটিকে সীমিত করতে চান নির্দিষ্ট সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে স্থাপিত বাস্তববাদী ফিকশনে, বিশেষ করে যেগুলো মানব প্রকৃতির মনস্তাত্ত্বিক নিরীক্ষা চালায়। তাদের এই সংজ্ঞা থেকে ওপরের দু-একটাই কেবল বাদ পড়বে, কিন্তু এই সংজ্ঞা অন্য উপন্যাসগুলোর বেশির ভাগকেই অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরে। (দ্য টেল অব গেনজি একটি ‘বাস্তববাদী’ উপন্যাস, ২০ শতকের আগেকার যেকোনো ইউরোপিয়ান উপন্যাসের চেয়ে যাতে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির দেখা মেলে।) কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বইগুলোর প্রথম দিককার সম্পাদকেরা এই উপন্যাসগুলোর অনেকগুলোকেই চিহ্নিত করেছেন ‘রোমান্স’ অথবা ‘সাগা’ অথবা স্যাটায়ার, লোকমহাকাব্য, পাস্টোরাল, পিকারেস্ক ও অন্যান্য পরিভাষায়, যা সাহিত্যের অধ্যাপকদের এই উপন্যাসগুলোকে অবহেলা করার সুযোগ দিয়েছে।  অথবা আমার বলা উচিত ‘সেসব অধ্যাপক’, যারা এগুলোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। আমার সন্দেহ, বেশির ভাগ অধ্যাপকই দ্য টেল অব লেডি অচিবুকো অথবা দ্য গোল্ডেন লোটাস-এর নাম শোনেননি, তাই এগুলো উপন্যাস কি উপন্যাস নয়, তা তাদের ভাবার বিষয়ও নয়।

আমি পূর্বাধুনিক উপন্যাসের আরও আরও নমুনা অব্যাহতভাবে খুঁজে নিই, কিন্তু সেটা সম্প্রতি এগুলো নিয়ে লেখার সিদ্ধান্তের আগে নয়। বুশ প্রশাসনের শুরুর দিকের দুঃসহ স্মৃতির বছরগুলোতে, প্রথাবিরুদ্ধ, নিরীক্ষাধর্মী যে উপন্যাসগুলো আমি ভালোবাসি সেসবের বিরুদ্ধে একধরনের তীব্র রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া হতো। যদিও সেসব উপন্যাসের স্রষ্টারা পামেলা দিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসের ঐতিহ্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন। জয়েসকে তারা এই নৈরাজ্যের স্থপতি বলে চিহ্নিত করেন এবং তারা বার্থ, পিঞ্চন, গাডিস, বার্থেল্ম ও ডিলিওর মতো পরবর্তীকালের নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের আক্রমণ করেন। আমার কাছে এটা এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি বলে প্রতীয়মান, যা সাহিত্যের ইতিহাসে অজ্ঞ কারও পক্ষেই ধারণ করা সম্ভব। জয়েস বড়জোর মহান উপন্যাসের ঐতিহ্য থেকে প্রথম বেরিয়ে এসেছিলেন এবং তার অনুসারীরা তা-ই করছিল, যা সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপন্যাসের লেখকেরা সব সময়ই করেন: উপন্যাসকে উপন্যাসই থাকতে দেওয়া। কতিপয় সমালোকেরা উপন্যাসের যে সংকীর্ণ সংজ্ঞাকে প্রাধান্য দেন, তা কেবল উপন্যাসের দীর্ঘ ভ্রমণপথের সাম্প্রতিক অংশটুকুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অথচ এর শুরু খ্রিস্টপূর্ব বিংশ শতাব্দীতে মিসরীয় ও সুমেরীয় গল্পগুলোর সঙ্গে এবং যা অব্যাহতভাবে রূপান্তরিত হবে উপন্যাসের বিবিধ কাঠামোয়, যত দিন লেখকেরা থাকবেন। কেবল সাম্প্রতিক, প্রচলিত ফিকশনগুলোই উপন্যাসের তকমা পাওয়ার যোগ্য বলে চিহ্নিত করাটা  অদূরদর্শিতা, একদেশদর্শিতা ও ঐতিহাসিক অজ্ঞতা।

যদিও সমসাময়িক ফিকশনই আমার কাজের ক্ষেত্র, তবু প্রাচীন উপন্যাস আমাকে যথেষ্ট প্ররোচিত করেছে এবং সমসাময়িক সমালোচকেরা করেছেন যথেষ্ট বিরক্ত, নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসগুলোতে বিশেষ জোর দিয়ে উপন্যাসের একটি সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত হতে। এমন সব উপন্যাস হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে আমি যতটা আশা করি তার চেয়ে আরও অনেক বেশিই, যেহেতু উপন্যাসগুলো সাধারণ পাঠক, নয় বিষেশজ্ঞদের কাছেই পরিচিত। আমার মনে হয়েছে আমি যদি এই শুরুর দিককার উপন্যাসগুলোর কথা অধ্যাপক ও সাধারণ পাঠকদের কাছেও ছড়িয়ে দিতে পারি, সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রকরণের অনিঃশেষ বৈচিত্র্যের আরও ব্যাপক মূল্যায়নের সাথে সাথে, প্রাগ্রসর নতুনত্ব প্রয়াসীদের প্রতি হয়তো আরেকটু সহনশীলতা তৈরি হবে। নিশ্চিত সেটা ঘটবে না, তবু ভাবলাম, একবার চেষ্টা করে দেখি।

মূল: স্টিভেন মুর
ভাষান্তর: শোয়েব করিম

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh