বিকল্প মুদ্রায় জমজমাট অবৈধ বাণিজ্য

হারুন-অর-রশিদ

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৩০ পিএম | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:৩৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

দেশে-বিদেশে চলছে জমজমাট অবৈধ অর্থের বাণিজ্য। দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। আবার দেশের ভেতরে চলছে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের মচ্ছব। প্রতিদিন ঘুষ-দুর্নীতির কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এই অবৈধ কারবারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তৈরি করেছে বিকল্প মুদ্রা। প্রশাসনের নাকের ডগায় জমজমাট হয়ে উঠেছে বিকল্প মুদ্রার লেনদেন।

হুণ্ডি, আমদানি-রফতানি ও বিটকয়েনের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনাটি অনেক পুরনো। তবে বিশ্বে পুরনো হলেও বাংলাদেশে নতুন- ক্যাসিনোতে কোটি কোটি টাকার নগদ লেনদেন। ক্যাসিনোতে প্রতি রাতে এক টেবিলেই লেনদেন হয় কোটি টাকা। টেবিলে কোটি টাকার খেলাকে সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ চিপস। এই চিপসের মূল্য ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এতে নগদ টাকা আড়াল করে টাকার খেলা জমজমাট হয়। এই চিপসের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারও করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশে অবৈধ চিপস ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায় সরকারদলীয় নেতাদের ক্যাসিনো সন্ধানের পর। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিলের ইয়ং মেনস ক্লাব ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখানে আটক হন যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সাংগাঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ। সেখানে উদ্ধার হয় চিপস ও টাকা। 

অন্যদিকে, গত ২০ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের অভিযানে জি কে শামীম আটক হন। তার কাছ থেকেও উদ্ধার হয় টাকা ও ক্যাসিনো খেলার উপকরণ। বিভিন্ন তথ্য মতে, দেশে প্রায় ৬০টি ক্যাসিনো রয়েছে। যেখানে জমাট চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতির অর্থ। বাংলাদেশের আইনে ক্যাসিনো পরিচালনা, চিপসে লেনদেন এবং ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের মানেই হলো মানিলন্ডারিং। এটি গুরুতর অপরাধ। 

তবে দেশে ক্যাসিনোতে নগদ লেনদেন, কয়েন ও চিপসের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও প্রশাসনের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এতদিন নীরব ছিল। বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে বিদেশ থেকে এসব সামগ্রী আমদানি করেছেন ক্যাসিনোর মালিকরা। কয়েকজন যুবলীগের নেতা আটক হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ইউনিট (বিএফআইইউ)। ইতিমধ্যে আটককৃতদের নামে ব্যাংকে অর্থ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওইসব অর্থ যেন উত্তোলন করে নিতে না পারে সেজন্য ব্যাংকগুলোকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছে বিএফআইইউ। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নগদ লেনদেনে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। 

একটি সূত্র জানায়, মানিলন্ডারিং ও অর্থ পাচার ঠেকাতে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করে বিএফআইইউ। সম্প্রতি আটক যুবলীগের নেতাদের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য সিআইডি বা অন্যকোনো সংস্থা থেকে চাওয়া হয়নি। ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। পুলিশ বা সিআইডি থেকে যাদের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাওয়া হবে, সেই তথ্য সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া যারা আটক হয়েছেন, তাদের নামে কোনো অ্যাকাউন্ট থাকলে যথাযথ ব্যক্তি ও কাগজপত্র ছাড়া অর্থ দিতে নিষেধ করা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিজের ও আত্মীয়স্বজনদের নামে অ্যাকাউন্ট থাকলে তার খোজ খবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের নামে কি পরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলোতে আছে তা জানার চেষ্টা চলছে। 

বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ‘মানিলন্ডারিং ও সন্দেহজন লেনদেন প্রতিরোধে আইনের মাধ্যমে আমাদের করণীয় ও ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যে কোনো উৎস থেকে তথ্য পেলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। সাম্প্রতিক কর্মকা- নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। অভিযুক্তরা ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো অপরাধ করে থাকলে তা তদন্তের মাধ্যমে বের করা হবে।’ 

দেশের এই চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির টাকা ছাড়াও ক্যাসিনোর টাকার ভাগ যেত বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে। এসব টাকা ওমান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরতো। কিছু টাকা আবার রেমিটেন্স হিসেবে দেশেও আসত। এর বাইরে অবৈধ কারবারের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালীরা, এমনকি আমলারাও। 

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শারমিন জাহান বলেন, ‘খালেদসহ আটককৃতদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। এগুলোর তদন্ত শুরু করব। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে কোন দেশের কোন ব্যাংকে টাকা গেছে সেটিও তদন্ত করে বের করা হবে।’

এদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এটি অবৈধ। কিন্তু গোপনে চলছে অবৈধ বিটকয়েনের ব্যবহার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থ আসছেও বিভিন্ন দেশ থেকে। বিটকয়েন হলো এক ধরনের সাংকেতিক মুদ্রা। অনলাইনে এর লেনদেন হয়ে থাকে। এতে নির্দিষ্ট ডলারের বিপরীতে একটি কয়েন দেওয়া হয়, গ্রাহক সেই কয়েন দেখিয়ে এর বিপরীতে অর্থ তোলে। ২০০৮ সালে কয়েকটি উন্নত দেশে এ মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন হয়। পরে বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই এদের এজেন্ট রয়েছে।

বিটকয়েন নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে বিটকয়েন সিস্টেম চালু করার জন্য একটি শক্তিশালী চক্র উদ্যোগ নেয়। বিটকয়েন আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ পাচারের একটি ‘হাই এনক্রিপশন কৌশল’। ওই চক্রটি দেশে বিটকয়েন প্রচলন রেখেছে। তাদের প্রধান টার্গেট প্রবাসী ব্যক্তি, কালো টাকার মালিক ও দুর্নীতিবাজরা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের বিপুল অর্থ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা ফেরত তদন্ত টিমের কাছে বিটকয়েন সংক্রান্ত নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত হাতে আসে। এ ঘটনার পরই গোয়েন্দারা বিট কয়েন সম্পর্কে নতুন করে ধারণা পেতে থাকে। এমনকি ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিটকয়েনে অর্থ লেনদেনের তথ্যও উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে বিডিকার্ড ইন্টারন্যাশনাল, বিটকয়েন লি. ও ভিসিই সেলার নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য পেয়েছে। এই কয়েনের মাধ্যমে খুব সহজে মালিয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রিয়া, কানাডায় অর্থ পাচার করতে পারছেন অবৈধ কারবারীরা। বিটকয়েন চক্রের বিভিন্ন দেশে রয়েছে এজেন্ট। তারা অনলাইনে নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে। বিশেষ করে বিদেশে থাকা প্রবাসীরা নির্দিষ্ট ডলারের বিপরীতে একটি কয়েন দিয়ে থাকে। এ কয়েন বাংলাদেশি এজেন্টের কাছে দিলে তারা টাকায় রূপান্তর করে সে পরিমাণ অর্থ দেয়।

বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। একক বছর হিসেবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৯০ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এই অর্থের ৮০ শতাংশই পাচার হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলে আমদানি-রফতানির আড়ালে। 

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে সুইজ্যারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ; দেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা (প্রতি ফ্রা ৮৬.৪১ টাকা ধরে)। এক বছর আগে, ২০১৭ সালে এ অঙ্কটি ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে আমানত বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh