মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হলে চাকরি কেন থাকবে?

ফারাবী বিন জহির

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৬:৫৮ পিএম

মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন বাঙালি জাতির সূর্যসন্তান। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের লাল-সবুজের পতাকা আর বিশ্বের বুকে এক গর্বিত মানচিত্র। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি আমাদের কাছে অনেক বড় মাহাত্ম্যময়। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি শুনলেই শ্রদ্ধায় নত হয়ে ওঠে হৃদয়।

বাংলাদেশ হয়তো ভবিষ্যতে আরো অনেক নামকরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী বা অন্য যে কোনো পেশার মানুষকে তৈরি করতে পারবে কিন্তু বাংলাদেশ চাইলেও আর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তৈরি করতে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষণজন্মা পুরুষ। তারা জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে নিজের জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে জাতিকে এনে দিয়েছিলেন মুক্তির স্বাদ।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আজ পর্যন্ত সেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা আমরা তৈরি করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধীকরণের বা অন্তর্ভুক্তিকরণের যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়া পরিবর্তন এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির সংজ্ঞায়ন মোট বারো বার করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে কিন্তু একটি অর্ডারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়ন করেছেন।

কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হবেন সেটি ১৯৭২ সালের অর্ডারে স্পষ্ট রয়েছে। এটি নিয়ে বারবার বিতর্ক করে মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণের কিছু নেই। ১৯৭২ সালের অর্ডারের যে ব্যাখ্যা তাতে বলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যে কোনো সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভুমিকা রেখেছেন।

কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত কোনো সংগঠিত দলের সদস্য না হন এবং হয়েও যদি সক্রিয় ভ‚মিকা না রাখেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পড়বেন না। উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের অর্ডারের ইংরেজি ভাষায় যা বলা আছে তা হচ্ছে: ‘ফ্রিডম ফাইটারস (এফএফ) মিনস অ্যানি পারসন হু হ্যাড সারভড এজ মেম্বার অব অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়ার অব লিবারেশন।’

অন্যদিকে ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান একটি পরিপত্র জারি করেন। এতে কারা মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হবেন তার সংজ্ঞা বা চারটি শর্ত দেয়া হয়।

এসব শর্ত হচ্ছে: যারা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশ হয়েছিল অথবা যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সই করা সনদ রয়েছে। এ চারটির যে কোনো একটি শর্তে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ পান মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীরা। যদিও এখন আবার বলা হচ্ছে চাকরিতে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধার কোটা সুবিধা না নিলে এখন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা পাবেন না।

১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণে ভিন্নতা রয়েছে। কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণেই ’৭২-এর নির্দেশ পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। আর এটি না করায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার।

অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। সেক্টর থেকে পাওয়া (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর এসব দলিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তর করা হয়েছে) দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জনের খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

এদিকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা লাল বইয়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইবিআরসিতে সংরক্ষিত ৭০ হাজার ৮৯৬ জনের মধ্যে অনেকের নাম এ তালিকায় নেই। অর্থাৎ এ তালিকাটিও অসম্পূর্ণ বলা যায়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সুপারিশকৃতদের নিয়ে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার। জোট সরকারের সময় সংখ্যা বাড়ে ৪৪ হাজার। যা ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিযোগ করে আসছে।

একটি বিষয় দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে মুক্তিযোদ্ধা ইস্যুতে জল কম ঘোলা হয়নি কিন্তু এতজল ঘোলা করেও একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তালিকা প্রণয়নের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি তারাও সনদ নিয়ে নিয়েছেন। নিয়েছেন সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।

তবে আশার খবর এই যে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের চলতি মাস পর্যন্ত ২৮৮ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ৫, মার্চে ২, এপ্রিলে ৪, মে-তে ৬৫, জুলাইয়ে ৬৯ এবং আগস্টে (২৬ আগস্ট, ২০১৯ পর্যন্ত) ৫০ জন। জামুকার ৬৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী (২৬ আগস্ট, ২০১৯ পর্যন্ত) মন্ত্রণালয় থেকে ১৪ জনের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে বাতিলকৃত বেসামরিক গেজেট ও সনদ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়।

বাতিলের ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০০২-এর ৭(ঝ) ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। এখানে বলা আছে, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, সনদপত্র ও প্রত্যয়নপত্র প্রদানে এবং জাল ও ভুয়া সনদপত্র ও প্রত্যয়নপত্র বাতিলের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ।’ কেউ প্রকৃত তথ্য গোপন করে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং যাচাই-বাছাইয়ের সব ধাপ পার হয়ে জামুকার সুপারিশের ভিত্তিতে সনদ পেয়ে গেলেও সেটি পরে প্রমাণিত হলে এ ধারা বলে তার সনদ ও গেজেট বাতিল হবে।

যাদের সনদ ও গেজেট বাতিল হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকে এটি অর্জন করেছেন ৭-৮ বছর কিংবা তারও আগে। সঙ্গত কারণে এসব সনদ ও গেজেটের ভিত্তিতে সম্মানী ভাতা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা তারা ভোগ করে আসছেন। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের চাকরির বিশেষ সুবিধা ভোগ ছাড়াও তার সন্তান কিংবা সন্তানদের সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন।

এখন প্রশ্ন সনদ বাতিল হলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি বাতিল হওয়া নিয়ে। কারণ মুক্তিযোদ্ধা সনদের বৈধতা না থাকলে স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পাওয়া চাকরির বৈধতাও থাকে না। কারণ যার ওপর ভিত্তি করে চাকরি হয়েছে সেটি বাতিল হয়ে গেলে ওই চাকরি না থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা, যে কোনো চাকরির নিয়োগপত্রে উল্লেখ থাকে, কোনো অসত্য তথ্য দিলে বা কোনো তথ্য গোপন করলে নিয়োগ বাতিল হবে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে চাকরি বাতিলের বিষয়ে এই পর্যন্ত সরকারের দৃশ্যমান কোনো শক্ত পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। যাদের সনদ বাতিল হয়েছে তারা এখন পর্যন্ত কি সুবিধা নিয়েছেন? তাদের সন্তান কিংবা সন্তানদের সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন কিনা? পেয়ে থাকলে সেই চাকরিগুলোর বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে? এই বিষয়গুলো অন্ধকারেই রয়ে গেছে।

তাই ভুল বা জাল সনদ দিয়েও যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তাহলে তা হবে জাতির জন্য লজ্জাকর এবং কলঙ্কজনক একটি বিষয়। সরকারকে অবশ্যই এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টিকে বিন্দুমাত্র হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠ অহঙ্কার আর এই অহঙ্কারের গৌরব গাথা রচনা করেছেন এই মুক্তিযোদ্ধারাই। তাই মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধা ইস্যুতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিলে ইতিহাসের বিচারে আমরা কলঙ্কিত জাতি হিসেবে পরিগণিত হব।

ফারাবী বিন জহির, লেখক ও গবেষক।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh