ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের গন্তব্য কোথায়?

সাইফুল হক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৪৯ পিএম

দেশে এখন প্রধান আলোচনার বিষয়- সরকারের ক্যাসিনোবিরোধী তথাকথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ইতিমধ্যে আটক হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, সোনা, ক্যাসিনোসামগ্রী। যেটুকু উদ্ধার হয়েছে তাও রীতিমতো হতবাক হবার মতো। ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের গডফাদার, চাঁদাবাজি, জবর দখল, মাস্তানি ও সন্ত্রাসের বড় বড় চাঁইয়েরা বিপুল অধিকাংশ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের আরও ক’জন হয়তো গ্রেফতার হবে; কিন্তু মাফিয়া সিন্ডিকেটের অধিকাংশই যে নিরাপদ থাকবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। যুবলীগের এক মাফিয়া সম্রাটের গ্রেফতার নিয়ে যে কানামাছি খেলা হয়েছে, তা সরকারের দ্বিধা, দোদুল্যমানতা আর সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার আশঙ্কা থেকেই যে এই সিদ্ধান্তহীনতা, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

গ্রেফতারকৃত ক্যাসিনো হোতা দুর্নীতিবাজরা ইতিমধ্যে রিমান্ডে। তবে তাদের সঙ্গে কারা যুক্ত এবং তাদের অবৈধ অর্থ কোন পর্যন্ত পৌঁছেছে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, রাজনীতিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাসহ কারা কারা এর ভাগ পেত তার পরিপূর্ণ তালিকা জানার কোনো সম্ভাবনা নেই। সরকার বা প্রশাসন যেটুকু চাইবে ততটুকুই হয়তো জানা যাবে। বছরের পর বছর ধরে সরকারি দল ও জোটের যেসব রাজনীতিক, থানা-পুলিশের ছত্রছায়ায়- ক্ষেত্রবিশেষে তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ক্যাসিনোসহ নানা অবৈধ ও অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনা করে এসেছে, তাদের প্রকৃত পরিচয় জানা যাচ্ছে না। তারা কেউই দায়িত্ব স্বীকার করছে না; এর কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। অথচ এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদদ ও যোগসাজশ ছাড়া দশক ধরে এই ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাবার ন্যূনতম কোনো অবকাশ নেই।

সমুদ্রে হিমবাহের ভাসমান খণ্ডাংশের মতো দুর্নীতি ও জালিয়াতির যেটুকু প্রকাশ হয়েছে তা নিতান্তই সামান্য। তবে এ থেকে দুর্নীতি, লুটপাট, টেন্ডারবাজি, অবৈধ ব্যবসা, বিদেশে অর্থ পাচার, সর্বোপরি দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে খানিকটা অনুমান নিশ্চয় করা যায়। পাশাপাশি দুর্বৃত্ত ও মাফিয়াদের কীভাবে রাজনীতিকরণ ঘটছে, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ও সংগঠিত মাফিয়ারা কীভাবে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ক্রমে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে তাও অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাত এবং মেগা প্রকল্পের মেগা দুর্নীতিসহ প্রায় সমস্ত সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তারকা দুর্নীতিবাজরা এই অভিযানের বাইরে। এদের বিপুল অধিকাংশের টিকিটিও স্পর্শ করা যাবে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে তার নিদারুণ অসহায়ত্ত প্রকাশ করে বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। কারণ কারই অজানা নয়। এদের হাত এতই লম্বা যে, যারা টানাটানি করবে তারাই ছিটকে পড়বে। সরকারের শরীক এক প্রাক্তন মন্ত্রী এখন সাক্ষ্য দিয়ে বলছেন, গত ১০ বছরে ৯ লাখ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। আর এক গবেষণামূলক তথ্যে জানা যাচ্ছে গত ১০ বছরে নতুন করে বাংলাদেশে ৫৬ হাজার কোটিপতি গজিয়ে উঠেছে। এর বেশিরভাগই যে চুরি, দুর্নীতি, লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করেই যে রাতারাতি এই বিশাল বিত্তবৈভব গড়ে তোলা হয়েছে তাও স্পষ্ট। ক্ষমতা যে দ্রুত অর্থবিত্ত গড়ে তোলার প্রধান বাহন, তা এখন আর কারও অজানা নয়। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতার কাছাকাছি যাবার, ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে পড়ার যে উন্মত্ত প্রতিযোগিতা তা এ কারণেই।

ক’দিন আগে নিউ ইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০০৭ সালের ১/১১ এর মত ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্যই তার সরকারের দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযান। প্রধানমন্ত্রীর এই উপলব্ধি নিশ্চয় ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। পাশাপাশি এর মধ্য দিয়ে এটারও পরোক্ষ স্বীকৃতি মিলেছে যে, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহ এবং তাদের নানা স্তরের নেতা-সংগঠকরা কী নজিরবিহীন বেপরোয়া দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট আর অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা পর্বতের মুষিক প্রসবের মতো। দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের যেসব কারণে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণ করা হয়েছে, তাদের ওপর থেকে শত শত নেতাদের তো গ্রেফতার করে জেলে পাঠানোর কথা। একই ব্যবস্থা কার্যকর হবার কথা যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ হরেক রকমের হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ নেতা-সংগঠকদের ক্ষেত্রে। তা হয়নি, হবে না। নিউ ইয়র্ক থেকে দেশে ফিরে ১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী আগে নিজের ঘর পরিষ্কার করার কথা বললেন। কিন্তু ঘর পরিষ্কার হচ্ছে না। পরিচিত ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজরা, সিন্ডিকেটের আসল হোতারা বহাল তবিয়তে আছেন।

ফলে আশঙ্কা করার কারণ আছে যে, মাদকবিরোধী অভিযান ও ভেজালবিরোধী অভিযানের মতো এই অভিযানও অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বরপুত্ররা দুধে-ভাতেই থাকবে। বস্তুত অতীতের ধারাবাহিকতায় এই আমলেও সরকারের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রায় সবাই, সবকিছু দুর্নীতিগ্রস্ত। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় এরাই প্রধান কুশীলব। এরাই দেশের নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায়। দিনের ভোট রাতে অনেকাংশে সেরে ফেলে সরকারকে আরও এক মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে, নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমলাতন্ত্রসহ সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যে নজিরবিহীন অন্যায় ও অনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে- তারপর এরা এখন আরও ক্ষমতাবান, স্বেচ্ছাচারী ও বেপরোয়া। ৩০ ডিসেম্বরের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ায় এরা এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে; ব্যতিক্রম ছাড়া এদের গায়ে হাত দেবার ক্ষমতা সরকারের নেই। সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে এদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদাহরণ নেই। সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ যেভাবে এক ধরনের ‘দায়মুক্তির’ বিধান করেছে তাতে এদের ক্ষমতার দাপট, স্বেচ্ছাচারীতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ আরও বিস্তৃত হবে।

স্পষ্টতই বর্তমান অভিযানের লক্ষ্য দুর্নীতির বিনাশ নয় বরং বলা যেতে পারে তাকে খানিকটা ‘সহনীয়’ পর্যায়ে রাখা, নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা, সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, মাস্তানি এত উলঙ্গ হয়ে পড়েছিল যে, তার লাগাম টেনে ধরা ছাড়া উপায় ছিল না। সরকারের কথিত ইমেজ রক্ষা বা ভাবমূর্তি উদ্ধারের সাময়িক কিছু পদক্ষেপ হিসাবেই এসব তৎপরতাকে দেখা যেতে পারে। এসব পদক্ষেপের সঙ্গে বাস্তবে দুর্নীতি উচ্ছেদের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। এসব নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখানোরও কিছু নেই। গেল ৩০ ডিসেম্বরের পর সরকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতার যে গভীর সংকট তা খানিকটা কাটিয়ে ওঠাও এই অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় সব সরিষাতেই ভূত। সে কারণে এই ধরনের সরিষা দিয়ে যে ভূত তাড়ানো যাবে না, সচেতন যে কেউই তা বুঝতে পারেন।

শুরুর দিকে মানুষ কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে জুয়াড়ি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বর্তমান অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তা মিইয়ে পড়েছে, পথ হারিয়েছে। এই মাফিয়া সন্ত্রাসী-জুয়াড়িরা ভয়ংকর, সন্দেহ নেই; এর চেয়েও মারাত্মক হচ্ছে যারা গোটা দেশ ও জনগণকে নিয়ে জুয়া খেলছেন, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে। গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে এবং ভোটের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ যারা রুদ্ধ করে আসছেন তাদের নানামুখী চরম কর্তৃত্ববাদী তৎপরতা। লাগামহীন এই কর্তৃত্ববাদী শাসনের জঠরেই বেড়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ মাফিয়া সিন্ডিকেট। আর লুণ্ঠন নির্ভর বিদ্যমান পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে এই দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, সে কারণে এই ব্যবস্থাকে বহাল রেখে দুর্নীতির এই ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা পাবার কোনো সুযোগ নেই। তাই যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই মাফিয়াতন্ত্রের জন্ম দেয়, জুয়াড়িদের লালন-পালন করে তার শেকড় উপড়ে ফেলা ছাড়া দেশ ও মানুষের আশাজাগানিয়া কোনো গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নেই।

লেখক: সাইফুল হক।
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh