চীনা প্রেসিডেন্টের নেপাল সফর

হিমালয়ের ভূরাজনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০১৯, ১০:০৪ পিএম | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৯, ১০:০৫ পিএম

গত ১২ অক্টোবর দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপালে পৌঁছান। দীর্ঘ ২৩ বছরের ব্যবধানে কোনো চীনা রাষ্ট্রপ্রধানকে ফের বরণ করল নেপাল। নেপালের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই এ সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

নেপাল সফরের আগে ভারতে বেসরকারি সফর করেন শি জিনপিং। সেখানে কৌশলগত কারণে কাশ্মীর প্রশ্ন আলোচিত হয়নি। বরং বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে চীন। যদিও কাঠমান্ডু বরাবরই জানিয়ে এসেছে, নয়াদিল্লির সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে নেপালে ভারতের প্রভাব অনেকাংশেই কমে আসতে পারে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি চীনের প্রতি বিশেষ নমনীয়। তিনি বলেন, ‘নেপাল ও চীন হচ্ছে সত্যিকারের বন্ধু ও সহযোগী। বাইরের পরিস্থিতির যে কোনো পরিবর্তন হোক না কেন, চীন ইস্যুতে নেপালের নীতি কখনো পরিবর্তন হবে না।’

ভারত মাঝে মাঝেই এটা স্পষ্ট করেছে যে, তারা চায় নেপাল যেন তাদের নিরাপত্তা ছাতার নিচে জড়ো হয়। তবে নেপালি জনগণ ও দেশটির সরকার সেই প্রস্তাবে রাজি নয়। অন্যদিকে, চীন নেপালের সার্বভৌমত্ব ও পররাষ্ট্রনীতির ওপর হস্তক্ষেপ না করার নীতি অবলম্বন করছে। যে কারণে নেপালে সাম্প্রতিককালে চীনের প্রভাব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। এবারের সফরে বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেসের নেতা শেন বাহাদুর দেউবা এবং নেপালি কমিউনিস্ট পার্টির সহকারী চেয়ারম্যান পুষ্প কমল দাহালের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন চীনা প্রেসিডেন্ট।

তবে চীনা প্রেসিডেন্টের এ সফরের পরিকল্পনা ছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে, যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চীনমুখী হয়েছিলেন ওলি। নেপালের ওপর ভারতের অর্থনৈতিক অবরোধের প্রতিক্রিয়াতেই ওই পথে হেঁটেছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন জোট সরকারের অংশীদার পুষ্প কমল দাহাল নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন। আর নেপালে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সরকার না থাকায় শি জিনপিং সফর বাতিল করেন। তখন থেকেই চীন বলে আসছে যে, ‘সুবিধাজনক সময়ে’ নেপাল সফর করবেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এখন হয়তো চীনের কাছে সেই সুবিধাজনক সময় এসেছে।

চীন ও নেপাল ২০১৭ সালে চীনা প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা প্রশ্নে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এর পর থেকে দুই প্রতিবেশী ট্রান্স-হিমালয়ান মাল্টি-ডাইমেনশনাল কানেকটিভিটি নেটওয়ার্ক নির্মাণে হাত মেলানোর পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করেছে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উৎপাদন সামর্থ্য, রেলওয়ে, মহাসড়ক, বন্দর, বিমান চলাচল, জ্বালানি খাতে বিনিময় বাড়িয়েছে। 

চীনা প্রেসিডেন্টের এবারের সফর সংক্ষিপ্ত হলেও তা চীন ও নেপালের মধ্যে মাল্টি-ডাইমেনশনাল কানেকটিভিটি নেটওয়ার্ক বাড়াবে, বিদ্যমান চীন-নেপাল ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতা অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করবে। সংক্ষেপে বলা যায়, এ সফর নিশ্চিতভাবেই ভূরাজনীতিতে নেপালের গুরুত্ব বাড়িয়েছে।

দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত পারস্পরিক সফর বিনিময় হচ্ছে, যাদের মধ্যে আছেন- আমলা, কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, মিডিয়া কর্মী, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা। কয়েক বছর ধরেই নেপাল ও চীনের মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া হচ্ছে। গত ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ৪০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নেপাল সফরে আসে। মূলত শি জিনপিং’এর উন্নয়ন মডেল সম্পর্কে নেপালি নেতাদের অবগত করতেই ওই সফর করা হয়। এক কর্মশালায় নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির ২০০ শীর্ষ নেতা অংশ নেন, যাদের মধ্যে ছিলেন- প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি, দলের কো চেয়ার পুষ্প কমল দাহাল, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীও। চীনা প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান সোং তাও।

তখন কে পি ওলি ও পুষ্প কমল দাহাল উভয়কেই আশ্বাস দিয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘এ দুটি দেশ শুধু ভৌগোলিক নৈকট্যের দিক থেকেই কাছাকাছি নয়, বরং দুই দেশেই কমিউনিস্ট দলের শাসন রয়েছে এবং সে কারণে তাদের মধ্যে আরও বৃহৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা ও উন্নয়নের সম্পর্ক সম্ভব।’

নেপালকে কাছে পেতে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি রুপি (৫৬ বিলিয়ন) সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দেশটির উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে এ অর্থ ব্যয় হবে। শি জিনপিং বলেন, ‘বিশ্বে বন্ধুত্বের একটি মডেল আমরা। দুই দেশের মধ্যে আর কোনো স্বার্থ নেই। চীন ও নেপালের মধ্যে বন্ধুত্ব, অংশীদারিত্ব এবং সমৃদ্ধির মাত্রা আরও উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চীন। নিকট ভবিষ্যতে দেশ দুটির মধ্যে আরও নির্ভরযোগ্য এবং সহজ সংযোগ সুবিধা নিশ্চিত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নেপালকে একটি ভূবেষ্টিত দেশ থেকে ভূসংযোগের দেশে পরিণত করতে চাই।’

একটি রেলপথ ও একটি টানেল নির্মাণের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে নেপাল। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক যোগাযোগ খাতে ভারত-নির্ভরতা কাটিয়ে চীনের ওপর ভরসা রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে দেশটি। এই রেল লিংক প্রকল্পটিকে নেপালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। ৭০ কিলোমিটারের রেলপথ প্রকল্পটি নেপালের কাঠমান্ডুর সঙ্গে তিব্বতের গাইরোনকে সংযুক্ত করবে। এরই মধ্যে চীনের বিআরআই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত এই প্রকল্প নিয়ে প্রাথমিক গবেষণা শেষ করেছে চীনা বিশেষজ্ঞ দল। এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বিস্তারে বিআরআই প্রকল্প হাতে নিয়েছেন শি জিনপিং। পাশাপাশি রাজধানী কাঠমান্ডুর সঙ্গে তাতোপানি ট্রানজিট পয়েন্টের সংযোগ হাইওয়ে উন্নয়ন এবং সেখানে আরও অধিক কাস্টমস পয়েন্ট খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর হাইওয়েটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চীনা প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, পর্যটন, বাণিজ্য, পানি সরবরাহ, জ্বালানি, অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে মোট ২০টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। 

উল্লেখ্য, নেপালের অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলে আসছে। নেপালের দুই-তৃতীয়াংশ বাণিজ্য ভারতের দখলে রয়েছে। এমনকি দেশটির জ্বালানির শতভাগ সরবরাহ করে ভারত।

গত ১৩ অক্টোবর শি জিনপিং-এর সম্মানে নেপালি প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। নেপাল দীর্ঘদিন ধরেই এক চীন নীতিতে বিশ্বাসী। দেশটি কখনো তিব্বতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে অনুমোদন দেয়নি বা তার ভূখণ্ডে চীনবিরোধী তৎপরতাকে সুযোগ দেয়নি। চীন এর বিপুল গুরুত্ব দেয়। বিদ্যা দেবী বলেন, ‘বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে এমন কোনো শক্তিকে বরদাশত করবে না নেপাল।’ এর আগের দিন কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে তিনি শি জিনপিংকে স্বাগত জানান। বিদ্যা দেবী প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীনা কর্তৃপক্ষ বিশেষ শুভেচ্ছাও পাঠিয়েছিল। দুই দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যে এমন সম্পর্ক নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণকেই নির্দেশ করে, যা ভারতের প্রভাব খর্ব করে এক নতুন ভারসাম্যের জানান দেয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh