অধ্যাপক সারওয়ার মো. সাইফুলাহ্ খালেদ
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৩৮ এএম | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ১০:২৯ এএম
লাহোরের একটি দর্শনীয় স্থান।
১৯৬৮ সাল থেকে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স করাচিতে স্টাফ ইকোনমিস্ট হিসেবে কাজ করছি। প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেল, তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে করাচির বাইরে আর কোথাও যাওয়া হয়নি।
১৯৬৯ সালের এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তান করাচির ইংরেজি কমেন্টারি লেখক মনজুরুল ইসলাম সাহেব প্রস্তাব করলেন- ‘চলেন লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, পেশোয়ার থেকে ঘুরে আসি।’ তখন করাচির পাকিস্তান কোয়ার্টারে তারই সরকারি বাসায় সাবলেট থাকি। তিনি ঢাকা বিশাববিদ্যালয়ে আমার এক বছর সিনিয়র, ইংরেজির ছাত্র ছিলেন। আমি অর্থনীতির। পূর্ব পরিচয় ছিল না। দুজনেই অবিবাহিত।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘খরচ কেমন পড়বে?’ তিনি বললেন- “দু থেকে তিনশ’ টাকা।” আমি বললাম- ‘এ ভ্রমণের খরচ আমার হাতে আপাতত নেই। আপনি যদি খরচ বহন করেন আমি তা পরে দিয়ে দেবো।’ তিনি রাজি হলেন। করাচিতে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ঢাকা যেতে পারলে উত্তম হতো। তাতে খরচ বেশি। করাচির বাইরে থেকে ঘুরে এলে মনটা কিছুটা হালকা হবে মনে করলাম। মনজুর সাহেবের প্রস্তাবে রাজি হয়ে ইনস্টিটিউট থেকে ছ’দিনের ছুটি নিলাম। প্রস্তুত।
রওনা হওয়ার আগের রাতে মনজুর সাহেবকে বললাম- ‘টাকা দিন।’ তিনি রাগ হয়ে বললেন- ‘আমি আপনার খরচ দিতে পারবো না।’ আমি বললাম- ‘আপনার কথা মতো আমি ছুটি নিলাম। কালকে দু’জনে যাব। এখন বলছেন খরচ দিতে পারবেন না। সে কি!’ তিনি বললেন- ‘না। আমার কাছে টাকা নেই।’ আমি বললাম- ‘তাহলে থাক।’ কিছুক্ষণ পরে এসে বললেন- ‘খরচের টাকা আমার হাতেই থাক। চলেন যাই।’ আমার হাতে মাত্র ক’টি টাকা আছে। একশ’ও নয়। বললাম- ‘একদম খালি হাতে যেতে ইচ্ছে করছে না।’ তিনি বললেন- ‘আমি তো সাথেই আছি।’ শেষমেশ যেতে রজি হলাম।
পরদিন দুপুরে করাচি রেল স্টেশন থেকে আওয়াম এক্সপ্রেস যোগে দু’জনে লাহোরের পথে রওনা দিলাম। সিন্ধু পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলো। রাতে অন্ধকারে বাইরে কিছু দেখা গেল না। ধুলা। সেকি ধুলা। ট্রেনের বগির ভেতরে ধুলার স্তর জমে গেছে। কাঠের সিটেই বসে আছি। বাঙ্কার আগেই দখল হয়ে গেছে। ঘুমোবার জো নেই। তাছাড়া তখন আমার কাছ থেকে ঘুম প্রায় ছুটিই নিয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায়ই রাতে বিছানায় ঘুম আসে না। আর এত জার্নি। বগির ভেতরের বিদ্যুৎ বাতির আলোয় দেখা যায় কি পরিমাণ ধুলা উড়ছে। গায়ের কাপড়চোপড় ঘন ঘন ঝেড়ে ধুলা সাফ করি। রাতটা জেগে বসেই কাটালাম। এরই মধ্যে কেউ কেউ সিটে বসে বেশ ঘুমিয়ে নিচ্ছে। কেউ এদিক ওদিক যাওয়া-আসা করছে। ট্রেনের নিরবচ্ছিন্ন ঘর্র ঘর্র ঘট্ ঘট্ একঘেয়ে শব্দ। ট্রেন কোন মুলুক কখন পার হয়ে যাচ্ছে তা কিছুই বুঝার উপায় নেই।
সকালের আলো যখন দেখা দিলো তখন ট্রেন মর্দান পৌঁছে গেছে। ধুলার প্রকোপও কিছুটা কমে এসেছে। বাইরে সবুজ কার্পাস ক্ষেত। পাশে কৃত্রিম খাল। পানি বয়ে চলেছে। দূরে ছাড়া ছাড়া ছোট ছোট বাড়ি। বাড়িগুলো ঘিরে অল্প গাছগাছালি। অনুমান করি এগুলো কৃষকের বাড়িঘর। আমরা পাঞ্জাব প্রবেশ করেছি।
ট্রেন যতই এগিয়ে চলেছে সবুজের ঘনত্ব বাড়ছে। দু’পাশে ফসলের ক্ষেত। মাঝে মাঝে ট্রেন থামছে। স্টেশনগুলোতে সবুজ গাছপালা। দুপুরের দিকে গুজরানওয়ালা পৌঁছালাম। এক লম্বা প্রসস্থ সুঠামদেহী সুদর্শনা বিদেশি যুবতী দেশীয় দুই যুবকের সঙ্গে বগিতে উঠল। মেয়েটির গায়ে লাল রঙের আাঁটসাঁট সালোয়ার কামিজে সোনালি সিল্কের সুতার রুচিশীল কাজ। মুখাকৃতির লালিত্য মনোহর। গায়ের রঙ রক্তাভ। যুবক দুটি বলিষ্ঠ দীর্ঘদেহী। শ্যামলা। পরের স্টেশনে তিন জনই নেমে গেল। মিচেলসের কমলার বাগান দেখা গেলো। ঘন সবুজ অরণ্য। এর পর থেকে ফসলি ক্ষেতে সেচের সুন্দর ব্যবস্থা। আবাদি জমির আইলের পাশ দিয়ে সরু নালা পথে র্তি র্তি করে সেচের পানি বয়ে যাচ্ছে। অল্প দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সড়ক পথে বাস ট্রাক চলাচল করছে। রেলপথ, সড়কপথ, আবাদি জমি- সব এক সমতলে। এখানে রাস্তা নির্মাণে মাটি ভরাটের খরচা লাগে না। মাটি সমতল করে অল্প খরচে সহজেই দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ করা চলে। বড় বড় পুল কালভার্ট নির্মাণেরও প্রয়েজন পড়ে না। সে কারণে এখানে রেল পথ সড়ক পথ উভয় পথই বি¯তৃত। বন্যায় বা অতিবর্ষণে রাস্তা ধ্বসে বা ক্ষয়ে যায় না, তাই পথ রক্ষণাবেক্ষণের রেকারিং এ্যক্সপেন্ডিচারও কম। সে দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ভাগ্যবান।
সন্ধ্যার অল্প আগে লাহোর এসে ট্রেন থামল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে এক ঘোড়ায় টানা টাঙ্গায় উঠলাম দু’জনে। স্টেশন রোডটির বিটোমিনের আস্তরণের ওপর ঘোড়ার শুকনা বিষ্ঠার ধূলির আস্তরণ। রাস্তার বিটোমিনের স্তর দেখা যায় না। শহরটি সবুজ। মনে হলো ঢাকা এসেছি। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাকৃতিক সবুজের শহর এই প্রথম দেখলাম। রাস্তার পাশে প্রাকৃতিকভাবে গজানো দুর্বা আর এ শহরের ঘনসবুজ গাছের প্রাচুর্য প্রথম দৃষ্টিতে আমাকে বিস্মিত করেছে। করাচিতে একাধারে বছরোর্ধ্ব কাল কাটিয়ে ভাবতেই পারিনি এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক সবুজের লীলাভূমি এমন একটি শহর থাকতে পারে! অবশ্য আমাদের ট্রেন ভোরে পাঞ্জাবের মর্দান প্রবেশের পর থেকে যতই উত্তরে এগিয়েছে, সবুজ প্রকৃতি ততই বিকশিত হচ্ছে। সেটাই লাহোরে এসে ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে।
একটি সস্তা দরের হোটেলে উঠেছি। একটি কামরা। দুটি বিছানা। মনজুর সাহেবের পছন্দ। তার থিউরি খাব থাকবো সস্তায়, দেখবো অনেক। থাকা-খাওয়া নয়, দর্শনীয় যা কিছু আছে সীমিত সামর্থ্যে তা সবই দেখে যাব। থিউরিটা মন্দ না হলেও আমার পছন্দ হয়নি। রাতের খাওয়াও অতি সাধারণ। বুঝলাম কেন মনজুর সাহেব আমার হাতে টাকা দিতে চাননি। করাচিতে আমার জীবন যাপনের মান দেখে পাকিস্তান স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউটের বাঙালি প্রকৌশলী আতাউল কবীর সাহেব আমাকে ‘প্রিন্স’ বলতেন। যাক, জীবনে এই প্রথম হোটেল বাস। রাতে প্রচুর বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির মিষ্টি মধুর শীতল বাতাস আমাকে ঢাকার কথা মনে করিয়ে দিলো। সকালে উঠে দেখি- প্রকৃতি পাট ভাঙ্গা নতুন সবুজ শাড়ি পড়েছে। এ যে আমার শ্যামল ঢাকা! আমি এতোদিন কোথায় ছিলাম! বুঝলাম কিসের টানে আইযুব খান সিন্ধু ছেড়ে পাঞ্জাব রাজধানী নিয়ে এসেছেন। প্রকৃতির উদার শ্যামলিমা জীবনকে টানে। এ রাজধানী আমার পূর্ব পাকিস্তানও হতে পারতো।
(চলবে)