কালোবাজারিদের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

হারুন-অর-রশিদ

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩১ পিএম | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৪৫ এএম

ক্যাসিনো কারবারিদের জুয়ার আসরে, অফিসের লকারে, ঘরের আলমারিতে ও বিশেষ সিন্দুকে মিলছে কাড়ি কাড়ি টাকা। চকচকে ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোটই বেশি উদ্ধার হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে উচ্চমূল্যমানের নোট। অল্পতেই বেশি টাকা। এজন্য ক্যাসিনো কারবারি, ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদের খায়েশ ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোটের। এই দুষ্কৃতকারীরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতার কাছাকাছি থাকেন। তাদের খায়েশ উচ্চমূল্যমানের নোট ব্যাপকহারে ছাপানো আর তা মেটাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উচ্চ মূল্যমানের নোট বাজারে বেশি থাকায় ব্যাংকের পরিবর্তে অফিস ও বাড়িতে টাকা রাখা সহজ হয়েছে। 

কালোবাজারি ও দুর্নীতিবাজদের অবৈধ লেনদেন এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বছর দেড়েক আগে ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধের পরামর্শ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু পরামর্শ দিয়েও এই দুই মূল্যমানের নোট ব্যাপকহারে ছাপাচ্ছে তারা। গত সাড়ে ৪ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পরিমাণ নতুন টাকা বাজারে ছেড়েছে, তার প্রায় ৯০ শতাংশই এক হাজার ও ৫০০ টাকার নোট। অন্যদিকে, জাল নোট কারবারিরা বড় অঙ্কের নোটই বেশি জাল করে। তাই স্বচ্ছ অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে নগদ টাকার পরিবর্তে ক্যাশবিহীন লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি সংশ্লিষ্টদের। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই সাড়ে চার বছরে সর্বমোট ৪১১ কোটি ৬১ লাখ ৩৫ হাজার ৪০১ পিস নতুন ব্যাংক নোট বাজারে ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নোটগুলোর মূল্যমান ১ লাখ ১২ হাজার ২০ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার টাকার নতুন নোট ছাপানো হয়েছে ৫৭ কোটি ৪৬ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ পিস। যার বাজারমূল্য ৫৭ হাজার ৪৬৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাজারে ছাড়া নতুন টাকার মধ্যে ১ হাজার টাকার নোটের পরিমাণই ৫১.২৯ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৫০০ টাকা মূল্যমানের নোট বাজারে ছাড়া হয়েছে ৮৪ কোটি ৮৪ লাখ ৭০ হাজার ১ পিস, যার বাজার মূল্য ৪২ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ ৫০০ টাকা। বাজারে ছাড়া মোট টাকার মধ্যে এই নোটের অংশ ৩৭.৮৭ শতাংশ। সবমিলিয়ে আলোচ্য সাড়ে চার বছরে বাজারে নতুন আসা নোটের মধ্যে এক হাজার ও ৫০০ টাকার নোট এসেছে ৯৯ হাজার ৮৮৯ কোটি ৬৪ লাখ ৫০০ টাকা, যা মোট টাকার ৮৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। অন্য ৪টি নোটের পরিমাণ মাত্র ১০.৮৩ শতাংশ। 

উল্লেখ্য, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটকে ব্যাংকনোট বলা হয়। এটি ছাপানোর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এই নোটগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের স্বাক্ষর থাকে। অন্যদিকে ১, ২ ও ৫ টাকার নোট ও কয়েনকে সরকারি নোট বলা হয়। এসব নোটে অর্থসচিবের স্বাক্ষর থাকে। 

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকিং লেনদেন উৎসাহিত করতে হবে। ব্যাংকের বাইরে বেশি নগদ লেনদেন হলে মানিলন্ডারিং বা দুর্নীতির লেনদেন বেশি হওয়ার সুযোগ থাকে। তবে কাগুজে নোটের মতো ডিজিটাল মানিও পাচার হতে পারে। এজন্য সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। 

আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে কম ছাড়া হয়েছে ১০ টাকার নোট। ৮৫ কোটি ৭১ লাখ ৪৭ হাজার পিস এই মূল্যমানের নতুন নোট ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার বাজারমূল্য ৮৫৭ কোটি ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। মোট টাকার মধ্যে মাত্র ০.৭৬ শতাংশ। ২০ টাকার নতুন নোট ছাড়া হয়েছে ৬৩ কোটি ২২ লাখ ৭৪ হাজার পিস, যার বাজারমূল্য ১ হাজার ২৬৪ কোটি ৫৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাজারে ছাড়া নতুন নোটের মাত্র ১.১২ শতাংশ। 

৫০ টাকার নোট ছাড়া হয়েছে ৪০ কোটি ৫৪ লাখ ২৬ হাজার পিস। যার বাজারমূল্য ২ হাজার ২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা। মোট টাকার মধ্যে এর অংশ ১.৮১ শতাংশ। এ ছাড়া ১০০ টাকার নোট ছাড়া হয়েছে ৭৯ কোটি ৮১ লাখ ৫৭ হাজার পিস। এই নোটগুলোর বাজারমূল্য ৭ হাজার ৯৮১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। মোট টাকার মধ্যে এর অংশ ৭.১২ শতাংশ। 

গত ২০১৭ সালের আগস্টে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি কমাতে নগদ লেনদেন কমানোর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন চায় অর্থ মন্ত্রণালয়য়। প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ নগদ অর্থ প্রচলিত আছে, কী পরিমাণ নগদ অর্থের প্রয়োজন রয়েছে, নগদ অর্থ প্রবাহের সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক, নগদ অর্থ বিনিময়ের ধরন ও ধারণের প্রকৃতি এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে নগদ অর্থ প্রবাহের ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করতে বলা হয়। করণীয় বিষয়ে পরামর্শ আকারে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রস্তাব পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, নগদে লেনদেন হওয়ায় অর্থের উৎস এবং সর্বশেষ ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায় না। এতে কর ফাঁকির ঘটনা বাড়ছে। কালো টাকা চিহ্নিত করা যায় না। বাজারে কালো টাকার বিস্তার থাকায় জমি, বাড়ি ইত্যাদি জিনিসের দাম অনেক বেশি রয়েছে। নগদ লেনদেন বন্ধ করা গেলে অর্থের উৎস এবং সর্বশেষ ব্যবহার সম্পর্কে সহজেই জানা যাবে। কর ফাঁকি কমে যাবে। আর্থিক দুর্নীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাবে। আর্থিক হিসাবে স্বচ্ছতা আসবে। নগদ লেনদেন কমানোর জন্য ১ হাজার এবং ৫০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধের কথা বলা হয়। নগদ টাকার পরিবর্তে অ্যাকাউন্ট টু অ্যাকাউন্ট লেনদেন বাড়ানোর কথা বলা হয়। কেউ ব্যাংক থেকে বেশি নগদ টাকা নিলে আবগারী শুল্ক বসানোর পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নগদের বিপরীতে কার্ডভিত্তিক, ইলেকট্রনিক, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এ অভিযানে জুয়ার আসর, অভিযুক্তদের বাসা ও অফিস থেকে কাড়ি কাড়ি নগদ টাকা উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধারকৃত টাকার মধ্যে এক হাজার টাকার নোটের বান্ডিল বেশি। এ ছাড়া রয়েছে ৫০০ টাকার নোট। বড় মূল্যমানের নোটে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা রাখা ও বহন সুবিধাজনক। 

তবে বড় নোট ছাপানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো শীর্ষ কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। ক্যাশবিহীন লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইইউ) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নগদ টাকার লেনদেন না করে বিকল্প বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করতে বলা হচ্ছে। এতে প্রতিটি লেনদেনের তথ্য থাকবে। সন্দেহজনক কিছু হলে সহজেই তা চিহ্নিত করা যাবে। এটি কার্যকর করা গেলেও মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় দু’বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে টাকার সংকট শুরু হয়েছে। ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেয়নি     প্রভাবশালীরা। ফলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ব্যাংকের বাইরে চলে যাওয়া অর্থ ব্যাংকে আর ফেরত আসেনি। গত মে মাসে বাজারে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকার নোট ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ওই মাসেই ব্যাংকগুলোতে টাকার সংকট ছিল সবচেয়ে প্রকট। ওই মাসে মানুষের হাতে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকার নোট ছিল। অন্যদিকে সর্বনিম্ন পরিমাণ নোট ছিল ব্যাংকের ভল্টে। বিপুল পরিমাণ নগদ লেনদেন বাড়লে মানিলন্ডারিংয়ের ঝুঁকি বাড়ে। কারণ নগদ টাকায় লেনদেন হলে টাকার হাতবদল সম্পর্কে কোনো তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh