ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব: ০২)

দেখার মাঝে

কাজী ইনাম

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:০৬ পিএম

সন্ধ্যা হতেই শিমুলডাঙ্গা গ্রামে নেমে আসে ভুতুড়ে নির্জনতা। বাতাসে গাছের পাতা কাঁপার শব্দ পাওয়া যায়। পাখিরা ডাকে না। রাস্তাগুলো হয়ে পড়ে জনমানবশূন্য। আর তার কারণ পর পর দু’দিন এ গ্রামে দুটি বড় রকমের অঘটন ঘটে গেছে। প্রথম দিন হোসেন মিয়ার রাইস মিলের পেছনে ধানক্ষেতের মধ্যে মস্তকবিহীন তিনটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। দ্বিতীয় দিন একই দৃশ্য দেখা যায় বড় রাস্তার পাশের জঙ্গলে। এবার লাশের সংখ্যা চার।

জহির পুকুর ঘাটে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার মন বিক্ষিপ্ত। কী সাংঘাতিক! এমন ঘটনা কে কবে দেখেছে? গ্রামের লোকজন অত্যাধিক নিরীহ। তারা এ কাজ করতেই পারে না। জিনের কা- এসব। খারাপ জিন। কোন কারণে রেগে আছে। গ্রামবাসীরতো সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই। যে যার মতো ঘরে বসে আছে। কে ঘটাতে পারে এ ঘটনা তোরা সেটা নিয়ে আলোচনা কর। ঘরে বসে থাকলেই কি পার পাবি?

রাত ৮টা বাজতেই বাজারের দোকানগুলো ঝাপ ফেলতে শুরু করে। দু-একটা সিগারেটের দোকান খোলা থাকে। দোকানি ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকায়। রমিজ মিয়ার বিষয়টা অবশ্য আলাদা। সে তার দোকান খুলে বসে আছে। তার মধ্যে ভয়-ভীতি কাজ করছে না। এ গ্রামের সবচেয়ে বড় ডাকাত মরহুম সাত্তার আলী তার মেজ ছেলে।

জহিরকে দেখে রমিজ মিয়া আঁতকে ওঠে। জহির তার টি-স্টলের সামনে রাখা বেঞ্চি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
এত রাত্রে বাইরে কর কী?
ঘরে থাকতে ভালো লাগে না।
সব সময় ভালো লাগা দিয়া চলা ঠিক না। সব সময় ভালো লাগা দিয়া চলে বলদে। বাড়ি যাও। বউ-বাচ্চারে নিয়া থাক। তোমার বউ তো আবার শিক্ষিত। স্কুলের মাস্টার। তার সঙ্গে থাক। জ্ঞান বাড়ব। অবশ্য বউর কাছ থেকে জ্ঞান নেওয়াটা সরমের বিষয়। তোমারও কি সরম লাগে?
একটু একটু সরম লাগে।
সরম পাওয়ার দরকার নাই। বউ শিক্ষিত হইলেও বউ বউ-ই। তার কাজ ভাত রান্না। চাউল ফুটাইতে না পারলে সে ফেল।
ঠিক কথা।
শুধু ঠিক না। ষোলো আনা ঠিক। মেয়েছেলে রান্না না জানলে সংসারে শান্তি থাকে না।
পুরুষ লোকের বিষয়ে তো কিছুই বললেন না।
তাদের থাকতে হয় রাগ। ঠিকমতো রাগতে জানলে একটা কেন চাইরটা বউ পালতে পারবা। আমার সাত্তার মিয়ার বউ তো উচ্চশিক্ষিত। ইন্টার পাস। আর সাত্তার মিয়া পড়ছে এইট পর্যন্ত। কই তাদের তো মিলমিশের অভাব ছিল না। কেন ছিল না জান?
মনে হয় রাগের কারণে।
হ্যাঁ, তার ছিল অত্যাধিক রাগ। একদিনের কথা বলি, শোন। সাত্তার ডাকাতি কইরা বাসায় ফিরছে। দেখে তার বউ খাটে শুইয়া ঘুমায়। দুপুর বেলার ঘুম সাত্তারের একদম পছন্দ না। সে বউটারে কোলে নিয়া পুকুরের পানিতে দিল ছাইড়া।
পানি কি ঠাণ্ডা ছিল?
মাঘ মাস। পানি ছিল বেজায়  ঠাণ্ডা
তারপর কী হলো?
তারপর আর কী হইব। বউ একদম সোজা। তোমারে কিন্তু ঘটনাটা খালি খালি বলি নাই।
তাইলে ক্যান বলছেন?
আরে বোকা, সিস্টেম শিখাইয়া দিলাম। মাঝে মইধ্যে প্র্যাকটিস করবা।
আনিসের মায়রে ধইরা পুকুরে চুবান দিব? তার কী অপরাধ?
ছিঃছিঃ। আমি কি সেই কথা বলছি? 
হেডমাস্টার সাহেব মাঠ পার হয়ে স্কুলের বারান্দার সামনে সাইকেল দাঁড় করায়। তারপর অনবরত সাইকেলের বেল বাজাতে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে হারিসের জন্য। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। তার ভয় লাগছে।
স্লামালাইকুম স্যার
স্লামালাইকুম স্যার

সে পেছন ফিরে তাকায়। হারিস তার ছেলেসহ দাঁড়িয়ে আছে। 
সারাক্ষণ ছেলে সঙ্গে নিয়ে ঘুরো কেন? তারেও কি তোমার মতো বানাইতে চাও?
না, সে গান গাবে। তার গলায় সুর আছে।
আমার রুমটা খুলে দাও। আর এক কাপ চা নিয়ে রুমে আস। ছেলেটাকেও নিয়ে আসবে।

হারিস ছেলে সমেত দাঁড়িয়ে আছে। তার রুম ত্যাগ করার অনুমতি মেলেনি। অথচ জরুরি কাজে এখন বাইরে না গেলেই নয়। সে সব সময় কিছু না কিছু করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু করে না কিছুই। হেডমাস্টার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে তার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে-কত কাজ জমে আছে। ইস্্ করা হচ্ছে না। বেকার লোকেরও অনেক কাজ থাকে। সে তো পুরোদস্তুর পিওন। নেশার ঘোরে থাকলে এক কথা। কিন্তু নেশা তো কেটে গেছে। এখন কাজের সময়। রাতের কাজ দিনে হয় না। এই যেমন অন্ধকার আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে থাকা - দিনে কি তা করা যাবে?

হেডমাস্টার সাহেবের মেয়ের নাম পারুল। সে মারা গেছে নয় বছর আগে। স্কুল ভবনটির পেছনে জংলার পাশেই তার কবর। মেয়ের কবর সে বাঁশের বেড়া দিয়ে সংরক্ষণ করেছে। তার ধারণা কবর বাঁধানো হলে মেয়ে আর তার মাঝে বাঁধার দেয়াল তৈরি হবে। মেয়ে আর তার কাছে আসবে না।

সে তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে ছেলেটার হাতে দেয়।
বুঝলে হারিস, চকলেট কিনি মেয়েটার জন্য। কিনে পকেটে রেখে দেই। সে পকেটে হাত দিয়ে কিছু না পেলে মন খারাপ করে।
বলেন কী স্যার? সে আপনার পকেটে হাত দেয়?
একদিন দিয়েছিল। আমি টের পেলাম আমার পকেট নড়ছে। তারপর কী একটা পকেট থেকে বের হয়ে গেল।
কী বাইর হইয়া গেল?
কী বের হয়ে গেল মানে? তার হাত বের হয়ে গেল। হাতে চুড়ি ছিল। আমি চুড়ির রিনঝিন শব্দ শুনেছি।
টাকা পয়সা নিয়া গেছে স্যার?
গর্ধবের মতো কথা বলবে না। সে টাকা দিয়ে কী করবে?
তাইলে পকেটে হাত দিছে ক্যান?মনে হয় চকলেটের জন্য। তারপর থেকে পকেট খালি রাখি না। চকলেট দিয়ে ভরে রাখি। 
সে কি চকলেট খাইছে?
খাক বা না খাক। বলতে তো পারবে তার বাবা তার জন্য চকলেট কিনে পকেট ভর্তি করে রাখে।
কাকে বলবে স্যার?
কাকে বলবে আমি কী করে বলব? তুমি তখন থেকে উল্টা পাল্টা কথা বলে যাচ্ছে। তোমার সমস্যা কী?
আমার সমস্যা হইল আফামনিরে আমিও দেখছি। সেইদিন রাইতে আমারে ডাক দিয়া কয় - হারিস চাচা, বাবা আসে না ক্যান?
বল কী তুমি? এত বড় কথা আগে বলনি কেন? সত্যি সে এসেছিল?
সে আসছিল স্যার। আমার ছেলের মাথায় হাত রাইখা বলতাছি।
তুমি তখন কী করলে?
আমি চোখ বন্ধ কইরা দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছাইলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারি নাই। সিঁড়ির ওপরে ঠাস কইরা পইড়া গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল হইয়া গেল।
দৌড় দিলে কেন?
ভয়ে দৌড় দিছি স্যার।
সে কি তোমাকে ভয় দেখিয়েছে?
নিজের মেয়ে নিয়া এই কথা কী কইরা বললেন? সে কি ভয় দেখানের মেয়ে? 
সে আজ আসবে না। আসলে এতক্ষণে আসত। তুমি কী বল?
এত কথার মইধ্যে আফামনি আইব না। তাছাড়া আইজ আকাশের অবস্থাও ভাল না। ঝড় বাদলা হইতে পারে।
আমি বের হয়ে যাচ্ছি, তুমি রুম বন্ধ করে দাও।

হারিস রুমে তালা দিয়ে দিলে হেডমাস্টার সাহেব সাইকেলে উঠে বসে। সে স্কুল ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠতেই হঠাৎ অনুভব করে সাইকেলের পিছে ভারী কিছু একটা চেপে আছে।
আস্তে চালাও বাবা, ঝাঁকি লাগছে। (চলবে)


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh