সৃষ্টিশীলতার ধ্বংসবাদ

হেলাল মহিউদ্দীন

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৫৯ এএম | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ০২:৪৩ পিএম

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

এক. পাবলো পিকাসো বলেছিলেন- ‘ধ্বংস করে ফেলতে চাওয়ার তাড়নাটিও একটি সৃষ্টিশীল তাড়না।’ 

কাফকা চাইতেন তার সব লেখা কেউ পুরোপুরি ধ্বংস করে দিক। সৃষ্টিকর্ম নিশ্চিহ্ন হোক চেয়েছিলেন রবার্ট ল্যুই স্টিভেন্সন, ভ্লাদিমির নবোকভ, নিকলাই গোগোল, দান্তে, ফ্রান্সিস বেকনসহ আরো কয়েকজনও। তারা চাইতেন নতুন ভাবুক-চিন্তক-লিখিয়েরা পুরনো ফর্মে থিতু না থাকুক।

পিছনের সময়ে আটকে না থাকুক। অগ্রজদের ভাষা-ভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত না হোক। বরং নিজস্ব ভাব, ভাষা ও ফর্ম নির্মাণ করুক। অনুকরণ-অনুসরণ করার বোকামো না করুক। 

বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিক দার্শনিকদের মধ্যে এই রকম সাহসিকতার একজনও ছিলেন না, এখনো নাই। ভাবাও যায় না একজনও এই সামান্য সাহসটি ভবিষ্যতে কোনোদিন দেখাবেন। বরং উলটো ভাব-ভাবালুতাতেই ভরপুর এই জমিনটি। এখানে কবি-সাহিত্যিকরা সামান্য নাম-ধাম হতে শুরু করলে বলেন- ‘আমি বেঁচে থাকতে চাই আগামীর পাঠকদের মাঝে।’ 

আহা কী আবেগ! বেঁচে থাকার কী আকুলতা! আসলে কী যে নার্সিসিস্টিক আত্মগরিমায় ভুগছেন মানুষটি! ভাবখানি ‘আমি তো বিরাট কিছু।’ যেন বলতে চাইছেন আমার সৃষ্টিকর্ম নষ্ট হয়ে গেলে দুনিয়ার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে; জ্ঞানজগতে আঁধার নেমে আসবে।

ধ্বংস করলে বরং উল্টোটি ঘটে। ধ্বংসস্তূপে পাওয়া হেরোগি-ফে, তুলোটে, প্যাপিরাসে, গুহাগাত্রে আঁকিবুকি চিহ্নের মানে উদ্ধারের কী সুতীব্র চেষ্টাই না থাকে মানুষের! মানুষের কৌতূহল-ঔৎসুক্য হতেই নতুন ব্যাখ্যা, নতুন ন্যারেটিভ, নতুন সৃজনশীলতা তৈরি হয়।

গ্রিক, আরবীয়, ভারতীয়, চীনা উপকথা-রূপকথাগুলো শুনে শুনে এই কান হতে ওই কান, এই মুখ হতে ওই মুখ হয়েই মহান সৃষ্টিকর্ম হয়েছে। ঈশপ-প্লেটো-সক্রেটিস ডায়াজিনিস সবার ভাবনাই শ্রুতিকার-লিপিকারদের এক হাত হতে আরেক হাতে পড়ে মহৎ সৃষ্টির রূপ নিয়েছে। 

দুই. রুমি ঘরের কপাট বন্ধ করে গভীর রাত পর্যন্ত কী যেন এক গুপ্ত বই পড়তেন। কাউকে দেখতেও দিতেন না। জানাতেনও না। তাঁর শিষ্যদেরও কৌতূহল আর ঔৎসুক্য কী রহস্যই না জানি লুকিয়ে আছে সেই বইতে! দীর্ঘ বারোটি বছর এই রকম চলল।

এলো রুমির মৃত্যুর দিন। শিষ্যরা রুমির মৃত্যুতে যতটা ভেঙে পড়ার কথা, তার ছিঁটেফোঁটাও হলো না। সৎকারের কথাও প্রায় ভুলতে বসেছিলেন তারা। সবার কৌতূহল সেই রহস্যঘেরা বইতে। সেটি যখন হাতে এল দেখা গেল তাতে কোনো লেখাই নেই। একেবারেই সাদা। একটি বর্ণও নেই তাতে। 

সকলে যেন উন্মাদ হয়ে গেল এই অক্ষর-বর্ণহীন বইয়ের রহস্য উদ্ঘাটনে। বইয়ের ভাষাহীনতাটি যে আসলে কোনো ভাষা সেটি আবিষ্কারে। অচিরেই তারা বুঝতে পারল এই ভাষা নীরবতার ভাষা, নৈঃশব্দ্যের রূপক; ‘নাই’-এর ভাষা- ‘আমি কিছু নই রে আমি কিছু নই’ এর সাইলেন্ট ন্যারেটিভ।

এই ভাষাই ছায়াচিত্রের মতো তাদের সবার স্মৃতিতে জাগিয়ে তুলল নৈঃশব্দ্য, নীরবতা, শূন্য ও শূন্যতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে রুমির সঙ্গে সংলাপ, বাহাস, বিতর্ক, আলোচনা। লিখন-পুনর্লিখনে রুমির শূন্যগ্রন্থই নতুন নতুন গ্রন্থে গ্রন্থে জীবিত-পুনর্জীবিত হয়েই চলেছে। 

কাফকার, দান্তের, গোগোলের কিংবা নবোকভের সৃষ্টিকর্ম তাঁদের ইচ্ছা মেনে নিশ্চিহ্ন করা হলে কি তারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেন? কখনো নয়। বরং তাঁরা নানাভাবে নানা বৈচিত্র্যেও ব্যতিক্রমে নিত্যনতুন ন্যারেটিভের ভেতর দিয়ে আরো বহুবর্ণা জীবন ও পুনর্জীবনসহ পাঠকের প্রিয়পাত্র হতে থাকতেন।

তিন. মাত্র গত বছরের ঘটনা। স্থান লন্ডন, ব্রিটেন। চিত্রকর্মের নিলাম হচ্ছিল। একটি চিত্রকর্মের দাম উঠল ১.৪ মিলিয়ন ডলার। ক্রেতার নাম ঘোষণার মুহূর্তেই সকলে দেখল চিত্রকর্মটি কয়েক টুকরা কাটাকাটা হয়ে ফ্রেমের নিচে নেমে ঝরে পড়ছে। সঙ্গে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। ফ্রেমের ভিতরে শ্রেডার মেশিন চলার শব্দ। সকলের চোখ ছানাবড়া। ইউটিঊবেও সেই ভিডিওটি আছে। 

কে ধ্বংস করল চিত্রকর্মটি?

আঁকিয়ে নিজে। ক্যানভাসটি যখন কাটা পড়ছিল তিনি হাসছিলেন। 

কীভাবে কাটা পড়ল ছবিটি? ফ্রেমের ভিতরে শিল্পী নিজেই একটি শ্রেডার মেশিন বসিয়ে রেখেছিলেন। উদ্দেশ্য যেদিন নিলামে উঠবে সেদিন হাতের রিমোর্টে চাপ দিবেন। শ্রেডার মেশিন চালু হবে। সৃষ্টিটি ধ্বংস হয়ে যাবে। 

তার নাম ব্যাংক্সি। এটি ছদ্মনাম, যে নামে তাঁকে সকলে চিনেন। ব্রিটেনের বড় আকারের বিশ্ববিখ্যাত গ্রাফিতিগুলোর বেশির ভাগই তাঁর সৃষ্টি। আচরণে তিনি একজন রহস্যমানব। তাঁর সম্পর্কে ইন্টারনেটেই যথেষ্ট তথ্য আছে বলে এই আলোচনা বাড়াচ্ছি না। 

ঘটনাটিকে স্টান্ট বলা হলেও ব্যাংক্সির উদ্দেশ্য ছিল ‘গার্ল উইদ অ্যা বেলুন’ নামের শিল্পকর্মটিকে সত্যিসত্যিই ধ্বংস করা। তাঁর সৃষ্টিশীল ভাবনার কাছে ১.৪ মিলিয়ন ডলারও ছিল নস্যি। যদিও তিনি উঠে এসেছিলেন নিতান্ত নিরন্ন, হতদরিদ্র ও গৃহহীন অবস্থা থেকে। 

ব্যাংক্সির চিত্রকর্ম ধ্বংসকান্ডটি উপস্থিত সবাইকে হতাশ করেছিল। কিন্তু চিত্রকর্মটিকে ময়লার বাক্সে ফেলে দেওয়া হয়নি। এখন জানা যাচ্ছে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা বা নষ্ট করে ফেলা চিত্রকর্মটির মান ও মূল্য বরং আরো বেড়েছে। ধ্বংস করার ঘটনাটির কারণে চিত্রকর্মটিতে আরো বেশি শিল্পমূল্য ও ইতিহাসমূল্য যুক্ত হয়েছে। এখন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্মের জায়গা দখল করে আছে চিত্রটি। ফলে দামও নাকি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

সৃজনশীলতাকে আসলে কখনো ধ্বংস করা যায় কি?

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh