আবুল খায়ের
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৪:৩৭ পিএম
দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী চলমান শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ঔৎসুক্যের সঙ্গে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও রাজনৈতিক কারণে বিভাজিত সমাজে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা তথা পারসেপশান অনুযায়ী চলমান অভিযানটি সেই কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।
চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানটি প্রাথমিকভাবে শাসক দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে শুরু হলেও জুয়া তথা ক্যাসিনো, চাঁদা ও টেন্ডারবাজি এবং অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার সম্পর্কে চলমান অভিযান অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সমর্থন করলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ততটা সরব নয়। পরবর্তীতে নিজেরা এর শিকার হওয়ার আশঙ্কায় সম্ভবত তারা একে সমর্থন বা প্রশংসা করতে পারেনি। এর নেপথ্যে সরকারি দলের তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার আগাম হুমকিও বহুলাংশে দায়ী। জনমতের প্রত্যাশা পূরণে দুর্নীতিতে জড়িত নিজ দল বা অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী উদ্যোগ দেশ-বিদেশের প্রচার মাধ্যমে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছে এবং তার ব্যক্তি ইমেজ ও সমর্থন বেড়েছে বটে। পক্ষান্তরে সরকারি রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। তবে দুর্নীতি-মুক্ত সমাজ আমাদের কাম্য হলেও অবৈধ আয়ে বিত্তশালী হবার প্রবণতা থেকে রাজনীতিবিদরা মুক্ত হতে না পারলে সাধারণের আকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
আমাদের এতদাঞ্চলে দুর্নীতির ইতিহাস সুদীর্ঘ। কাজীর বিচার-পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসকেরা স্বদেশে সৎ থাকলেও উপনিবেশকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। সাধারণকে বিব্রত ও ব্যস্ত রাখার কৌশল গ্রহণ করার ফলে অদ্যাবধি ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতায় পরিগ্রহ লাভ করেছে। ব্রিটিশ শাসনামল এবং দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানি প্রথম দশ বছর মুরব্বিরা যুবক শিক্ষার্থীদের পুলিশের দারোগা হবার জন্য আশীর্বাদ করতেন। পরবর্তীতে সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খাঁ ক্ষমতা ছিনতাই করে গণতন্ত্রের নামে অদ্ভূত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে। তৎকালীন পাকিস্তানে ৮০ হাজার চেয়ারম্যানের সরকারি উন্নয়ন ও বিদেশি ত্রাণ লুটবার মহাযজ্ঞ শুরু হলে মুরব্বিরা চেয়ারম্যান/মেম্বার হবার জন্য আশীর্বাদ দেওয়া শুরু করেন। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্নীতি নিয়ে লিখেছেন ‘ব্রিটিশরা একদিন এদেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে, তবে যেসব অপকীর্তি, দুর্নীতি আর অপশাসন এই দেশে রাখিয়া যাইবে তাহা হইতে মুক্তি পাইতে ব্রিটিশ শাসনকালের দ্বিগুণ সময় লাগিবে’। কবি গুরুর আশঙ্কা সময়ের পরিক্রমায় সঠিক বলে মনে হচ্ছে। যে সন্তান তার অভিভাবক দেখে, সামান্য দিনের ব্যবধানে আর তেমন কোনো পরিশ্রম না করেই বিপুল বিত্ত-বৈভব অর্জন করে, অবচেতন মনেই তার মনে দুর্নীতি করে বিত্তশালী হবার অনুপ্রেরণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। সুশিক্ষার অভাবে অনেকেরই লক্ষ্য হয়ে ওঠে যেভাবেই হোক আয়েশী জীবনযাপনের।
মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বুর্জোয়া শাসনে মানুষ এমনিতেই বিলাসী হওয়ায় অর্থের চাহিদা বেড়ে গেছে। কুড়ি-পঁচিশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে মেধাহীনের চাকরি কিনতে হলে সে অবলীলায় লগ্নিকৃত অর্থ সুদ-আসলে তুলে আনতে অবৈধ আয়ের পথ তৈরি করে নেবে সেটাই স্বাভাবিক। অশ্রমিককে শ্রমিক নেতা, অকৃষককে কৃষক নেতা, ষাটোর্ধ ব্যক্তিকে যুব নেতা, ব্যবসায়ী ছাত্রকে ছাত্র নেতা, স্বেচ্ছায় সেবা না জানাকে স্বেচ্ছাসেবক নেতা বানানোর ফলাফলতো ইতোমধ্যে জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। রাজনীতির মূল আদর্শ না জানা ব্যবসায়ীকে জন-নেতা বানানো ‘সিং নাই, তবু নাম তার সিংহ’র মত শোনা যায়। বিজয়ী হবার জন্য এলাকার মাস্তানকে কাউন্সিলর বানিয়ে জন কল্যাণের পরিবর্তে সমাজটাকে কলুষিত করে ফেলেছে আমাদের রাজনীতি। বিশ্ব বাংকের জরিপে মোট এগারটি কারণে উন্নয়নশীল ও উন্নয়নকামী রাষ্ট্রসমূহে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সুশীল সমাজের নির্লিপ্ততা, দুর্নীতি দমনে কঠোর আইনের প্রয়োগের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও প্রচার মাধ্যমের তাবেদারী চরিত্র, জন-প্রশাসনে যোগ্য ও সৎ আমলাদের অভাব, বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়-নীতি প্রতিপালনের অভাব এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের শাসন অন্যতম। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামল ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পূনর্গঠন, ভারত থেকে ফিরে আসা প্রায় এক কোটি শরণার্থীদের পুনর্বাসন, ধ্বংসপ্রায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করা, খাদ্যাভাব মোকাবেলা করা, অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করা, দেশী-বিদেশী দেশ বিরোধী শত্রুদের মোকাবেলা করা, স্বাধীন দেশের জন্য যুগোপযোগী সংবিধান প্রণয়ন করাসহ পক্ষ-বিপক্ষের ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ বিভীষণদের ষড়যন্ত্র থেকে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও আদর্শ রক্ষার ব্যস্ততম সময়। দলীয় দুর্নীতিবাজ কতিপয় নেতাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শাস্তিমূক ব্যবস্থা নিলেও বাঙালি-প্রেমিক বঙ্গবন্ধু সামাজিক অনাচার রোধে গড়পরতা ‘লাল ঘোড়া’ দাবড়াতে পারেননি, আর এটাই বাস্তবতা। ১৯৭৫’র পট পরিবর্তনের পর অদ্যাবধি কোন শাসনামলেই দুর্নীতি-বিরোধী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ১-১১ এর সামরিক ছত্রছায়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেমে প্রকারান্তরে নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় লাগাতার তিন মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় সিদ্ধন্তের তোয়াক্কা না করে একক সিদ্ধান্তে স্বীয় দল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন, যা তার ও তার দলের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
নিঃসন্দেহে তার এই উদ্যোগ যুগান্তকারী ও প্রশংসারও দাবি রাখে। বিষয়টি এই পর্যন্ত থেমে থাকলে আশঙ্কার কিছু ছিল না। কিন্তু দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে অবৈধ আয়ের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীল হয়ে চলমান অভিযান বলবৎ রাখার সরকারি প্রত্যয়ে ২২-২৫ জনের গণভবনে প্রবেশাধিকার বাতিলের সংখ্যাটি বেড়ে গেলে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশের চেয়ারে বসার নেতাদেরও হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বিচারপতি আ. সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলে দলের অপরাপর উচ্চাকাংখি নেতৃবৃন্দের অসহযোগীতায় ভীষণ একা হয়ে পড়েছিলেন। সেসময় তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন থেকে খুনের মামলায় পলাতক আসামি ইমদু গ্রেপ্তার হলে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিদায়-ঘণ্টা বেজে যায়। সুযোগটি জেনারেল এরশাদ লুফে নিয়ে প্রকারান্তরে সামরিক আইন শাসক হলে গণতন্ত্র দীর্ঘদিনের জন্য হিম ঘরে চলে গিয়েছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি দল শুদ্ধি অভিযানকে যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, সেখান থেকে ইউটার্ন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমনিতেই রাজনীতির প্রতি সাধারণের আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে নানাসময়ে রাজনীতিবিদদের উদঘাটিত অপকর্মের কারণে। গন্তব্য বা লক্ষ্য স্থির না করে শুরু করা এই যাত্রার শেষ কেউ জানি না বলেই অজানা আশঙ্কা তো থেকেই যায়। তবুও মন্দের ভালো হিসেবে দুর্নীতি-মুক্ত সমাজ আর রাজনীতির প্রত্যাশা করি, তবে অজানা পরিণতির আশঙ্কায় বলি ‘সাধু সাবধান’।
লেখক: আবুল খায়ের,
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক, পিএমও।