৪৮ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের

এস.এস শোহান, বাগেরহাট

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৫৮ এএম

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

উদাসীনতা, অবহেলা ও অযত্নে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বাগেরহাটের শরণখোলার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সমাধিস্থল। 

সংরক্ষণের অভাবে তাঁর সমাধির আশপাশে বিভিন্ন লতাপতা জন্মেছে। পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা কবরের উপরেও ভেঙে পড়েছে ছোটখাট কয়েকটি গাছ। এভাবে চলতে থাকলে কোনো এক সময় হারিয়ে যাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের শেষ স্মৃতিটুকু। 

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা এই বীর শহীদের সমাধি সংরক্ষিত না হওয়া ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সহযোদ্ধারা। সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদাপূর্ণ পদের চাকরি ফেলে রেখে দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনগণ।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৪৪ সালে শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী সংলগ্ন দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার হোসেন। আলেপ খান ও জুমিনা খাতুনের চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে আনোয়ার ছিলেন সবার ছোট। ১৯৬৬ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে করাচি আর্মিতে যোগদান করেন তিনি। সর্বশেষ পাকিস্তানের খানে ওয়ালা ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। চাকরির মায়া ত্যাগ করে, জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে  শরণখোলাবাসীকে সংগঠিত করে ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সুন্দরবনে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন তিনি। 

 শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সমাধিস্থল। 

বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পাক-হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তাঁর নেতৃত্বে একাধিক হামলায় অনেক পাকিস্তানী সেনা সদস্য নিহত হয়। রাজাকারেরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে তার সাহসী কার্যক্রম।

আনোয়ারের ভাই হেমায়েত উদ্দিন খানও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তাঁর সঙ্গে। অপর দুই ভাই শাফায়েত খান ও সায়েদ খান পাকিস্তান আর্মির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বন্দি ছিলেন পাকিস্তানে। 

১৯৭১ সালের ১১ জুলাই আনোয়ার তাঁর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শরণখোলা থানা ঘেরাও করেন। পাকিস্তনিনী সৈন্য বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছুড়ে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালায়। দুইপক্ষের গুলি বিনিময়ের সময় ক্যাপটেন আনোয়ার গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলে মারা যান। পরে তাঁর মরদেহ তাঁর সহযোদ্ধা শেখ শামসুর রহমান ও মনিরুজ্জামান বাবুল গোপনে নৌকায় করে বাড়িতে পৌঁছে দেন। রাত ১২টায় বলেশ্বর নদীর তীরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। 

ক্যাপ্টেন আনোয়ারের ভাই হেমায়েত উদ্দিন খানকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি ভাতাপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের খোঁজ নেয় না কেউ। এর মধ্যে বলেশ্বরের ভাঙনে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের কবর। 

২০১৫ সালে স্থানীয় সংবাদকর্মী নজরুল ইসলাম আকনের দাবির প্রেক্ষিতে উপজেলার প্রশাসন ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের দেহবাশেষ তুলে শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা বাজারস্থ শহীদদের সমাধিস্থলের অদুরে রাস্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। কিন্তু তারপর থেকে ওই সমাধিকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। 

ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের কবরটি রয়েছে খোলা জায়গায় চরম অবহেলায়। চেনাই যাচ্ছে না লতা-পাতায় আচ্ছন্ন তার সমাধিস্থল। গবাদি পশুর অবাধ বিচরণও রয়েছে সেখানে। এমনকি তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিকে দায়মুক্ত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।

 শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সমাধিস্থল। 

ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সহযোদ্ধা শেখ শামসুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তিনি অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তার নেতৃত্বেই শরণখোলা থানা ঘেরাও করা হয়। ওই সময় সম্মুখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আমরা তার মরদেহ খুব গোপনে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম।

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোফাজ্জেল হোসেন পঞ্চায়েত ও হারুনুর রশীদ জানান, যুদ্ধের সময় পাশে থেকেই ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের বীরত্ব দেখেছি। তিনিই শরণখোলা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক ও শরণখোলার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর প্রতি অবহেলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননার শামিল। আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর সমাধিস্থল নির্মাণ ও মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ অবদান রাখায় তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করার দাবি জানাই।

ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের ভাগনে শিক্ষক আব্দুল খালেক হাওলাদার বলেন, সেনাবাহিনীর মর্যাদাপূর্ণ চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন মামা আনোয়ার হোসেন। কিন্ত অবহেলা ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। এমনকি তার কবরের জায়গাটুকুও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। জানি না কি স্বার্থে তাঁর অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আনোয়ার হোসেনের বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বলেন, বয়স হয়েছে কথা বলতে কষ্ট হয়। ভাইয়ের কথা শুনেই কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, সেনাবাহিনীর অফিসার পদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশের জন্য শহীদ হলো আনোয়ার। আজ তাঁর কোনো নাম নেই। মুক্তিযুদ্ধের কোনো অনুষ্ঠানেও কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করে না। মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার ক্যাপ্টেন আনোয়ার। মৃত্যুর আগে একটাই দাবি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাইয়ের স্বীকৃতি চাই।

শরণখোলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার এম.এ খালেক খান বলেন, সুন্দরবন কেন্দ্রীক শরণখোলা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক হলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। তিনি সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। তৎকালীন ৯নং সেক্টরের সাব-সেক্টেরের দায়িত্ব প্রাপ্তদের অবহেলা উদাসীনতার কারণে এ শহীদের নাম নিশানা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। জানি না এখানে কি রাজনীতি ছিলো। তাকে ভুলে যাওয়া, তাঁর কবরস্থান হারিয়ে যাওয়া জাতির জন্য লজ্জাজনক। তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা খেতাব দেয়া উচিৎ।

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরদার মোস্তফা শাহিন জানান, শহীদ ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর প্রতি অবহেলা দেখানোর কোনো সুযোগ নাই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা নিয়ে বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস উপেজলার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh