২০১৯ সালের স্বাস্থ্য খাত

দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলায় কেটেছে বছর

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:১৪ পিএম | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:২৭ পিএম

ছবি: গুগল ফটো

ছবি: গুগল ফটো

আগের বছরের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি দেওয়া হলেও এ খাতটি কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত করা সম্ভব হচ্ছে না অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে। প্রচুর চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কর্মস্থলে তারা অনুপস্থিত থাকছেন, এমন কথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীই বলছেন বিভিন্নভাবে। কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত ওষুধ দেওয়া হয়েছে প্রচুর। কিন্তু এসব ওষুধও নয়ছয় হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে এমন রিপোর্ট রয়েছে। 

এ বছরই বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে ডেঙ্গু অব্যবস্থাপনা নিয়ে। সময়মতো মশা মারতে ব্যর্থ হওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি হিসাবেই এক লাখ এক হাজার ২৪৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রথমবার ব্যাপকভাবে ২০০০ সালে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। তখন এর চিকিৎসা বাংলাদেশের ডাক্তাররা জানতেন না বলে দেশব্যাপী পাঁচ হাজার ৫৫১ জন আক্রান্ত হলেও, মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। কিন্তু এখন এর চিকিৎসা সবার জানা থাকা সত্ত্বেও ২৬৬ জন মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। সময়মতো মশার ওষুধ দেওয়া হলে এতো মানুষ আক্রান্ত হতো না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা মারতে ব্যর্থ হয়েছে। 

চলতি বছরে স্বাস্থ্য খাতে অনেকগুলো দুর্নীতি প্রকাশ হয়। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, বিভাগীয় প্রধান, পরিচালক, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্নীতির এসব প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে। গোটা প্রক্রিয়ার সমন্বয় করেন ঠিকাদার এবং মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে কর্মরত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা একাধিক ব্যক্তি। স্বাস্থ্য খাতের ১১টি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন চলতি বছর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে তুলে দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতি রোধে সংস্থাটির ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছিল দুদক।

এ ছাড়া দুদক চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুর্নীতির অনুসন্ধানে ১৯ ধরনের কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় গাইবান্ধার সিভিল সার্জন, সিলেটের সিভিল সার্জন, বগুড়ার সিভিল সার্জন, বগুড়ার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। চিঠি দেওয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল, কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।

পাশপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আবদুর রশিদ, সহকারী পরিচালক (বাজেট) ডা. আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আনে দুদক। 

চলতি বছরের প্রথমদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানি আবজাল হোসেনের হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে দুদক। তবে ওই একজনকে নিয়েই দুদক ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অধিদপ্তরের বিভিন্ন দপ্তরে ঘাপটি মেরে থাকা অসংখ্য আবজাল পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। 

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ (ফমেক) হাসপাতাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) রোগীর চোখে বাইরের আলো যেন না লাগে সেজন্য এক সেটা পর্দা কিনেছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায়! শুধু এ পর্দা নয়, চিকিৎসা সরঞ্জামাদিও এরকম উচ্চ দাম দিয়ে কেনা হয়েছে। এভাবে ফমেকে প্রায় ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে। এই পুকুর চুরির ঘটনা এ বছর প্রকাশ হলেও এসব কেনা হয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। এ ব্যাপারে তদন্ত করতে সম্প্রতি দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

রংপুর মেডিকেল কলেজে (রমেক) যন্ত্রপাতি কেনার নামে সরকারের ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে দুদক। রমেকে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর মামলায় কলেজটির অধ্যক্ষসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। 

হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার কেনাকাটায় দুর্নীতির ঘটনায় তদন্তে নেমেছে দুদক। দরপত্রের মাধ্যমে কেনাকাটায় প্রতিটি জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্য দেখানো হয়। এটা ধরা পড়ে ডিসেম্বর মাসেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের যুগ্ম সচিব (নির্মাণ ও মেরামত অধিশাখা) আজম খানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয়ছে। কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। 

স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মিঠু এবং কেরানি আবজালের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। কেনাকাটা ও আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের নামে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন তারা। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তাদের চক্রের ছয় সদস্যের মধ্যে দুই জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, দুই জন পরিচালক ও উপ-পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গাড়ি চালকও রয়েছেন এ চক্রে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদপ্তর ছাড়াও প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্বাস্থ্য বিভাগীয় অফিস, সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ সকল স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব জায়গায় তাদের পদচারণা।

সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে আউটসোর্সিং বা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে সেবা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে। যে পরিমাণ বেতন প্রতিটি নিয়োগপ্রাপ্তদের দেওয়ার কথা, তার অর্ধেক অংশ ওই ঠিকাদার নিয়ে যায়। অপরদিকে, প্রতিটি নিয়োগেও চাকরি দেওয়ার নামে তারা কয়েক লাখ টাকা প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে নিয়েছেন। অথচ নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

জানা গেছে, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে চার/পাঁচ মাস পরপর নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিবাদ করলেই ছাঁটাইয়ের হুমকি দেওয়া হয়, ফলে ক্ষোভ থাকলেও প্রতিবাদ করার সাহস পায় না কর্মচারীরা। স্বাস্থ্যখাতে অনেক প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার ঘোষণা ছাড়াই কোটি কোটি টাকার কাজ শত শত ভাগে বিভক্ত করে কেবল রিসিট ভাউচারের মাধ্যমেই কেনাকাটা হয়। কাগজপত্রে ক্রয় দেখানো হয় উচ্চমূল্যে। কিন্তু কেনা হয় নিম্নমানের জিনিসপত্র। অনেক হাসপাতালে এসব যন্ত্র এখনো বাক্সবন্দি হয়ে আছে।

প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্র কেনার নামে পুকুর চুরি হয়েছে। মেডিকেল কলেজটির আসবাব কেনার নামে প্রায় ২১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেট এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। 

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপো বা সিএমএসডি) প্রায় ২৬ কোটি টাকা ‘নয়ছয়’ করার প্রমাণ পেয়েছে সংসদীয় কমিটি। জানা যায়, সিএমএসডি কর্তৃক বিদেশি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত লোকাল এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে পণ্য আমদানিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় ওষুধ নীতি উপেক্ষা করে বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কেনার কারণে ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকারও বেশি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh