ধর্ষণ বন্ধ হয় না কেন?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:২৩ এএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ মামলার আসামি মজনু যেদিন (১৬ জানুয়ারি) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন, সেদিনই ঢাকার কেরাণীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের ভৈরবে তিনজন ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে আসে।

কেরানীগঞ্জে পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার ৮ বছরের শিশু। ঘটনাটি জানাজানি হয় তিনদিন পর। অভিযুক্ত স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী বলে ভুক্তভোগীর পরিবার বিষয়টি গোপন রেখে মেয়েটির চিকিৎসা করাচ্ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য খারাপ হলে তাকে ১৬ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপরই সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে পারেন। 

ভৈরব রেলস্টেশনের কাছে একটি নির্জন স্থানে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক কিশোরী, যিনি টঙ্গী থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য ভৈরবে নেমে বাসের সন্ধান করছিলেন। মানিকগঞ্জের সিংগাইরে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে স্বামীর হাত-পা বেঁধে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এর কয়েকদিন আগে শুধু রাজধানীতেই পরপর তিনটি শিশুকে ধর্ষণের খবর আসে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে যখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন, ঠিক সেই সময়ে পরপর অনেকগুলো ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। 

তার মানে কি এই যে, একটি ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হলেও কিংবা ধর্ষকের বিচার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন শুরু হলেও সেই বার্তাটি ধর্ষকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না এবং সুযোগ পেলেই একজন পুরুষের ভেতর থেকে ধর্ষকের চেহারাটি বেরিয়ে আসছে? তার মানে কি এই যে, সব পুরুষের ভেতরেই একজন ধর্ষক বাস করে এবং সুযোগ পেলেই সেই ধর্ষকের বীভৎস মুখোশটি উন্মোচিত হয়?

রাজধানীর অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা ঢাকা সেনানিবাস সংলগ্ন কুর্মিটোলা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বলে এর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সংবাদমাধ্যম যেভাবে এই ঘটনাটি ফোকাস করেছে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তা যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, ভৈরবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া কিশোরী, কেরাণীগঞ্জে প্রভাবশালীর দ্বারা পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার শিশুটি কিংবা মানিকগঞ্জে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনাটি হয়তো সেভাবে মিডিয়ায় ঠাঁই পায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সেভাবে তোলপাড় তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। 

অর্থাৎ এখানে ব্যক্তির পরিচয় ও শ্রেণিচরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তির অবস্থানভেদে একইরকম ঘটনার একেকরকম প্রতিক্রিয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষিত হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মূলধারার সংবাদমাধ্যম যেভাবে ‘উত্তেজিত’ হয়ে ওঠে, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে অথবা ভৈরবের কোনো স্কুলছাত্রীর ধর্ষিত হওয়ার খবর হয়তো সংবাদমাধ্যমের কাছে সেভাবে বড় কোনো খবর নয়। অথচ ওই একই নারী-শিশু রাজধানীর কোনো অভিজাত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হলে তার প্রতিক্রিয়া হতো ভিন্ন। 

তবে প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক না কেন, যে প্রশ্নটি বারবার সামনে আসছে তা হলো- ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত অনেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন; তাদের হত্যার পর গলায় ‘হারকিউলিস’ লেখা চিরকুট ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রচলিত আদালতে বিচার না করেই অপরাধীদের মনে এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দিতে রাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যার পথও বেছে নিয়েছে, খোদ সংসদে এমপিদের কেউ কেউ ধর্ষকদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার দাবি তুলেছেন, কিন্তু তারপরও ধর্ষণের খবর কমছে না। তার মানে ক্রসফায়ারও ধর্ষণ দমনে ব্যর্থ হচ্ছে।

এই ঘটনাটি আরো যে বার্তাটি স্পষ্ট করে দেয় তা হলো- একটি অন্যায় দমনের জন্য আরেকটি অন্যায় (বিচারবহির্ভূত হত্যা) কখনো সমাধান নয়। পৃথিবীর কোনো দেশই বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে সমাজকে অপরাধুমক্ত করতে পারেনি। বরং বিচারবহির্ভূত হত্যা বাড়লে সেই রাষ্ট্র ‘বর্বর’ হিসেবে বিবেচিত হয়। 

কেন ধর্ষণ বন্ধ হয় না বা সভ্য ও উন্নত বিশ্বেও কেন ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে নানা মতো ও বিশ্লেষণ রয়েছে। যে ব্যাপারে সবাই একমত তা হলো- শুধু একটি বিচ্ছিন্ন কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে না, বা হুট করে একজন লোক ধর্ষক হয়ে ওঠে না। এজন্য তার বেড়ে ওঠা, তার পারিপার্শ্বিকতা, তার শিক্ষা-রুচি-সংস্কৃতি, আইনের প্রতি তার ভয়-আস্থা ও শ্রদ্ধা, নারী ও শিশুর প্রতি তার শ্রদ্ধা-মমত্ববোধ-ভালোবাসা, নারীকে সে কতটা নারী ভাবে আর কতটা মানুষ, সে যে সমাজে বাস করে সেই সমাজে মানুষকে মানুষ ভাববার মতো মানুষের সংখ্যা কতো ও সেখানে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের কতখানি সুযোগ রয়েছে- এরকম অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজে করে।

ফলে প্রায় শূন্য অপরাধের দেশ, যেমন- নেদারল্যান্ডস বা নরওয়ে অথবা ডেনমার্কেও একজন নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারেন, যদি সেখানে উপরোল্লিখিত বাস্তবতা বিদ্যমান থাকে। তবে এটা ঠিক, সেসব দেশের ধর্ষণের সঙ্গে অনুন্নত ও তুলনামূলক কম শিক্ষিত ও কম সচেতন সমাজে ধর্ষণের মধ্যে কিছু চরিত্রগত তফাৎ রয়েছে। 

ধর্ষণ বন্ধ না হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ- যারা এসব ঘটনার পেছনে থাকে, অনেক সময়ই স্থানীয়ভাবে তারা প্রভাবশালী। ফলে ভুক্তভোগী পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে ভয় পায়। তাদের মনে এই শঙ্কাও কাজ করে, পুলিশ ও আদালতের কাছে গেলে তারা আদৌ ন্যায়বিচার পাবেন কি না, নাকি নতুন করে সংকটের জালে পেঁচিয়ে যাবেন। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার মাত্র ২০ ভাগ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। বাকি প্রায় ৮০ ভাগ থেকে যায় বিচারের বাইরে। ফলে আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের এই ভরসাহীনতা, বিচার পাওয়ার সহজ পথ না থাকা, প্রভাবশালীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে নিজের ও পরিবারের জন্য আরও বড় হুমকি তৈরির যে শঙ্কা তাও সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো ব্যাধি নির্মূলের একটি বড় অন্তরায়। 

এর সঙ্গে আছে ঘৃণা ও বিভেদের সংস্কৃতি। সব ঘটনার পেছনেই এখন যেহেতু ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হয়, সে কারণে অনেক সময় ধর্ষণ বা এরকম অন্যায়ের শিকার হওয়া ব্যক্তিটি যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী মতের অনুসারী হন, তাহলে তার পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে এখন এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়ে গেছে, বিরোধী মতের লোককে খুন করা এমনকি ধর্ষণ করাও জায়েজ। সবকিছুকে এভাবে জায়েজীকরণ বন্ধ না হলে ধর্ষণ বন্ধ হবে না। 

সব ঘটনার প্রতিক্রিয়া সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রাষ্ট্রের তরফে একইরকম না হওয়ায়, সমাজের বিস্তীর্ণ পরিসরে এই বার্তা এখনো পৌঁছেনি- ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ এবং এটি করলে তিনি যে-ই হোন না কেন, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে তিনি যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, তার ক্ষমা নেই। 

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে, কুমিল্লার তনুর ক্ষেত্রে তা একেবারেই অনুপস্থিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর ক্ষেত্রে যা হয়েছে, কেরাণীগঞ্জ-ভৈরব-মানিকগঞ্জ অথবা দেশের অন্য কোনো প্রান্তের অন্য কোনো ঘটনায় সে ধরনের প্রতিক্রিয়া আসেনি। 

যদি সব ঘটনার ক্ষেত্রে একইরকম প্রতিক্রিয়া আসতো, যদি সব ঘটনায় তাৎক্ষণিক ও দ্রুত বিচার করে সারা দেশের মানুষের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যেত, সত্যিকারেই ন্যায়বিচার ও সুবিচার নিশ্চিত করা যেত, তাহলে ধর্ষণ শূন্যের কোঠায় না হলেও অন্তত বহুলাংশে কমিয়ে আনা যেত। 

এক সময় সারাদেশে এসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছিল। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সারা দেশে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ফলে এখন এসিড সন্ত্রাস প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের বিশাল ভূমিকার কথাও অস্বীকার করা যাবে না।

শিশু ধর্ষণ প্রমাণ করা কঠিন। কারণ ঘটনার শিকার শিশু অনেক সময়ই সঠিকভাবে বলতে পারে না। তার মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক কাজ করে। সে অনেক সময় বোঝাতেও ব্যর্থ হয়। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা ধর্ষণ বা এরকম শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয় পরিবারের লোকদের দ্বারাই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না বা পাশের বাড়ির লোকরাও জানে না। 

তার মানে যে সমস্যাটি বছরের পর বছর শুধু নয়, বলা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমাজে বিরাজমান, হুট করে বা একটি ঘটনার পর গড়ে ওঠা আন্দোলনেই সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। 

প্রথমত, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তির পরিচয় নয়, বরং সব ঘটনাকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তা সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রাষ্ট্রের শীর্ষ মহল থেকে। 

ফেনীর নুসরাত কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ঘটনায় রাষ্ট্র নড়েচড়ে বসবে অথবা কুমিল্লার তনুকে রাষ্ট্র ভুলেই যাবে- এই স্ববিরোধিতা বন্ধ করা না গেলে ধর্ষণও বন্ধ হবে না। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh