বই দীর্ঘজীবী হোক

জাঁ দেরিদাঁ

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০১:১৭ পিএম | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০১:৪৫ পিএম

পৃথিবীতে বই সব সময়ে এবং এখনো প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম প্রহেলিকার মতো। কাকে আমরা বই বলে থাকি? এখনো আমরা কাকে বই বলে অভিহিত করি? এসব প্রশ্নই বা এখন এই মহৎ দেশে এমন আশ্চর্যভাবে মনে উঠছে কেন?

এ-কথা সত্য যে এই প্রশ্নগুলোর আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা আছে। বইয়ের বিকাশের নীতি এবং এর বাজার ও তার ফলে উদ্ভূত দেশের অভ্যন্তর ও বহির্ভাগে আদান প্রদান- এ থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি এই বিষয়ে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গতিশীলতা সৌভাগ্যক্রমে কেবলমাত্র টাকা ও ডলারের বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্ষেত্রে এ এক বড় রকমের পদক্ষেপ ঘটিয়েছে; সে জন্য ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের কর্তৃত্ব প্রতিরোধ করতে কিছুটা সফল হয়েছে।

এ সবই যারা বই ভালোবাসেন তাদের মনে আনন্দ সঞ্চার করেছে। বই কাকে বলে? এই প্রশ্নের ক্ষেত্রেও এসব এক বিশেষ লক্ষণীয় ছায়া বিস্তার করেছে। বই এবং তার ইতিহাসের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে? বিশেষ করে এই প্রশ্নগুলো এখানে ভারতের পটভূমিতে বিচারের জন্য উঠেছে।

ভারত বহু ভাষা এবং প্রাণবান ধর্মের দেশ, সেখানে চিহ্ন এবং চিত্র এর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটছে। যখন আমি বলি যে আমার সারাজীবন অতিবাহিত হয়েছে বইয়ের সারবস্তু, উৎপত্তি, ভাগ্য এবং লক্ষ্য, এবং ফলত বইয়ের চূড়ান্ত পরিণাম ইত্যাদি সব প্রশ্ন ঘিরে তখন মনে হয় না আমি হতাশার কাছে সহজে হার স্বীকার কিংবা কোনোরূপ অতিরঞ্জন করছি। বরং বইয়ের ভাগ্য ও চূড়ান্ত পরিণামের প্রসঙ্গে বলা যায়, বইয়ের ক্ষেত্রে ভাগ্য ও চূড়ান্ত পরিণাম সংখ্যায় একের চেয়ে বেশি।

বইয়ের বিষয়ে আমরা যে প্রবল আগ্রহ দেখাই এবং সমস্ত বিষয়টি ভালোভাবে লক্ষ্য করে থাকি তার কারণ এই বিস্ময়কর বস্তুটির ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে আঘাত এসে পড়ছে। বইয়ের প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধি, বইয়ের বাজারের প্রসারণ সত্ত্বেও আমরা জানি এসব উদ্ভাবনের, পুরনো ও নতুন, ফলদায়ক কাল সীমাবদ্ধ; সেই সব সভ্যতার মতো মরণশীল যা, আমার এক বিশিষ্ট স্বদেশবাসীর উক্তি উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘নিজেই জানতো তা অমর নয়’; এবং বই ছাড়া কোনো সভ্যতা থাকা সম্ভব নয়।

সুতরাং আমরা হচ্ছি বইয়ের অভিভাবক। আমরা সব সময় সতর্ক থাকি এবং বইকে রক্ষা করি; কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা এক নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করি কারণ আমরা জানি না আমরা কোন জীবন্ত বস্তু, যা নানাভাবে প্রাণের চিহ্ন প্রকাশ করে থাকে তাকে রক্ষা করছি কিনা।

বই কোনো জীবন্ত বস্তু না, ধীরে ধীরে তার মৃত্যু হচ্ছে- এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় না। যদি শেষের মতটি সত্য হয় তাহলে বইমেলা অপচয় বলে বোধ হবে। সকল মরণশীল প্রাণীর মতো বই এখন এক যন্ত্রণার মধ্যে কাল কাটাচ্ছে, যদি না তার জীবন ও মৃত্যুর মাঝে একটি জায়গায় স্থিতি লাভ করে এবং আপনাদের কাছে ও আপনাদের মতো আর সবাই যারা এই আন্তর্জাতিক পটভূমির সঙ্গে বিজড়িত তাদের কাছে সে যা বার্তা পাঠাবে সেই হবে অবশ্য-পালনীয় আদেশের তুল্য।

আপনাদের মতো আমিও বই ভালোবাসি। আমি যা ভালোবাসি তা হলো বই। বই সঙ্গে না নিয়ে যদি জন্মে থাকি, পৃথিবীর যে অংশে জন্মেছিলাম সেখান বই যদি দুষ্প্রাপ্য ছিল, তাহলেও আজ আমাকে যা বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে বলা যায় বইয়ের পরিবেশ। স্কুলজীবন থেকে বইকে শ্রদ্ধা করতে আমাকে শেখানো হয়।

শ্রদ্ধা দুই অর্থে- বই এক জীবন্ত প্রাণ হিসাবে এবং বই পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে। বই হলো  এক ‘পবিত্র’ বস্তু যা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবহার করতাম। পৃষ্ঠাগুলো দু’ভাগ করে কাটতাম- সে সময় বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো জোড়া থাকতো- পৃষ্ঠা উল্টালেই এক বিস্ময়কর ও রহস্যময় জগতের দ্বার যেন উন্মুক্ত হতো।

বই মানব-ইতিহাসের প্রথম যুগের সময়ে পিছিয়ে নিয়ে যেত। হাত ও চোখের নাড়াচাড়ায় এই ক্ষুদ্র বস্তুটি, যা আমাদের চেয়ে এত বেশি ঐশ্বর্যশালী ও পবিত্র, আমাদের একেবারে সম্মোহিত করে ফেলত। এ ছাড়া ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ, বিভিন্ন ভাষায় লেখা। এগুলো হলো মানুষের সংস্কৃতির আত্মা। আপনাদের সকলের মতো আমার নিজেরও মনে হয় যে, এবং তা যতই কৃত্রিম বোধ হোক না কেন বইয়ের মধ্যেকার লেখার সাহায্যে কেমন করে কথা বলতে হবে, চিন্তা করতে হবে এবং লিখতে হবে তা আমি জানতে পেরেছি এবং বইয়ে যা শেখানো আছে তা না জানলে আমার শরীর, চোখ, হাত-পা সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। যে স্থানটুকু এই সম্মোহিনী খ-গুলো আমাদের কাছে দাবি করে তাকেই আমরা বলে থাকি বই।

আমার শরীর বইয়ে অঙ্গীভূত- একথা জোর দিয়ে বলার জন্য কোনো কোনো মানুষের বিদ্রুপাত্মক প্রতিবাদের অর্থ আমি বুঝে উঠতে পারি না। এটা কী সম্ভব? তবুও প্রিয় বন্ধু, ভদ্র মহিলা-ভদ্র মহোদয়গণ, আপনাদের সামনে এমন একজন দাঁড়িয়ে আছেন যিনি ত্রিশ বছরেরও বেশি আগে লেখা এবং প্রকাশিত একটি বইয়ে সাহস করে বলেছিলেন, বইয়ের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। এমন একজন যিনি বইয়ের অবশ্যম্ভাবী প্রতিচ্ছবি ও পরিণতির রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। এমনকি বইয়ের শিরোনাম বদল করে এক লেখক, এবং সম্ভবত এক নতুন লেখকের, জন্ম দিয়েছিলেন। এই রোগনির্ণয় এখন দুর্ভাগ্যক্রমে তুচ্ছ ব্যাপার মনে হতে পারে।

কিন্তু ১৯৬৫ সালে এটা ছিল বিস্ময়কর, সন্দেহজনক এবং এমনকি বিপজ্জনক। তখন বিচার করে বলা হয়েছিল এটা শুধু ভ্রান্ত নয়, মারাত্মকও বটে, যেন কোনো হত্যার সহায়ক বস্তু। তখন এই অভিযোগ খ-ন করেছিলাম, এখনও খন্ডন করছি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দীর্ঘ বিচার-বিশ্লেষণ করে যা বলা হয়েছিলো, আমি কেবলমাত্র জোর দিয়ে বলতে চাই, বইয়ের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে আমার যে ধারণা ছিলো, এবং একই সঙ্গে যা একটি নতুন দর্শন, নতুন নীতি, বইয়ের সম্পর্কে এক নতুন অর্থনৈতিক চেতনা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা, তা আজও পূর্বের চেয়ে বেশি মাত্রায় বিদ্যমান।

শিক্ষার প্রসার, কম্পিউটারে সাহায্যে মূল তথ্যের সংরক্ষণে নতুন ব্যবস্থা, যোগযোগ এবং প্রকাশনার কারণে ক্রমবর্ধমান এবং দ্রুতগতিতে বইয়ের বিকল্প ব্যবহারের যে ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল তারই ফলে বইয়ের তথাকথিত মৃত্যু ঘটবে। একবার যদি বইয়ের প্রকাশ বন্ধ হয় এবং প্রচার মাধ্যমের ওপর আঘাত আসে তাহলে সমগ্র জনচেতনা এবং সেহেতু আইন ও রাজনীতির সম্পর্কিত ধারণা, চিরদিনের জন্য বদলে যাবে। এটা নিছক কাগজের ব্যবহারজনিত সমস্যা নয়।

কারণ প্রকাশ মাধ্যমের উদ্ভাবনার বিচিত্র ইতিহাসে লিপি খোদাই করার জন্য পাথর, গাছের ছাল, কাঠ, লোহা এবং চামড়া ইত্যাদি যে-সব বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যবহার একসময় বহুল প্রচলিত ছিল এবং ধর্মের নির্দেশে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়নি সেগুলো যদি আবার পুনরুজ্জীবিত করা যায় এবং অবলুপ্তির জগৎ থেকে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়, তবুও মাধ্যম হিসাবে কাগজের ব্যবহার ঠিকই অব্যাহত থাকবে।

এটা হলো প্রধানত প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন, যাকে বলা যায় চিত্র -এর প্রাধান্য বিস্তার- যা টেলিভিশন, সিনেমা এবং আরো বিভিন্নমুখী মাধ্যমের জন্য ঘটছে এবং সে সবের জটিলতা এবং শক্তি অভূতপূর্ব গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এর সুফল কেবলমাত্র প্রযুক্তি সংক্রান্ত বা অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে ঘটেনি। এখন এ কথা কেউ অস্বীকার করার চিন্তাও করতে পারে না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব সম্পর্কে যা এখন বাজারের বিশ্বায়ন নামে পরিচিত, কিংবা এর ফলে সমাজে যে সাম্য এবং সমশ্রেণির উদ্ভব বা যে নিরপেক্ষতা দেখা দেবে বলে অনুমান করা হয়, সে বিষয়ে আমাদের নিজেদের প্রতারিত করা বা অন্যদের ধোঁকা দেওয়া উচিত নয়।

একথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে, বইয়ের বদলে অন্য মাধ্যম ব্যবহারের আন্দোলন, যা লাইব্রেরি ও বইয়ের দোকান থেকে শুরু করে যেখানে গবেষণা, শিক্ষাদান ও জ্ঞানচর্চা হয় সর্বত্র প্রসারিত তা সমগ্র মানব সমাজের পরিস্থিতির কথা বিচার না করে করা হচ্ছে।

এই পরিবর্তনের সঙ্গে যে সুফল এবং ঝুঁকি বিজড়িত তার মূল্য নির্ণয় আমরা যে ভাবেই করি না কেন, বস্তুত এই নিরূপণ ভয়ঙ্করভাবে জটিল। এই প্রক্রিয়া অনিবার্যভাবে দ্রুত হচ্ছে; বরং বলা যায় এর সঙ্গে আরো পরিবর্তন ও রূপান্তর জড়িয়ে আছে। এসব কিছুই প্রকৃতপক্ষে সব রকম সংস্কৃতির ছন্দে এবং বাহ্যিক গঠনের রূপান্তর আনছে- ভাষার সঙ্গে ভাষার, জাতির সঙ্গে জাতির, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক এবং অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও রূপান্তর ঘটাচ্ছে।

কিন্তু মুখ্যত বিজ্ঞান, বিভিন্ন জীবের সঙ্গে সম্পর্ক, পাঠক হিসাবে আনন্দের বাস্তব চেতনা, আমাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা, অন্য অনেকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ইত্যাদির বিষয়ে আমাদের যে নিবিড় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক আদান প্রদান ছিল সেসব কিছুরই পরিবর্তন আনছে। 

অতএব, এখন আমরা বই নিয়ে কী করতে চাই? কেউ কি শুধুমাত্র নতুনভাবে বই-প্রেম বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়বে- যা কেবল স্মৃতিমেদুর বা কোন প্রাচীন বস্তুর বেদনাময় মরণোন্মুখ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন। উত্তরে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলব, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই ‘হ্যাঁ’। আমরা বইয়ের স্বার্থের জন্য লড়বো।

(তথ্যসূত্র : কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় পঠিত বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত রূপ)

ভাষান্তর : শাহনাজ দীপা

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh